রিজেন্ট সাহেদ ও আরিফ চৌধুরীরা সমমনা, বোমা ফাটালেন সাবরিনা
অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরীগল্পের পেছনেও কতো গল্প অজানা থেকে যায় , মানুষ তার কতোটুকুনই বা জানতে পারে। ছোটোবেলায় আমার বাবার মুখ থেকে যে কথাটি শুনতে শুনতে বেড়ে উঠেছি সেটি হলো God makes a man but dress makes a gentle man ... বাবার মুখ থেকে শোনা কথাটির অমর্যাদা করতে চাইনি কখনও , আজও না। তবে পরিতাপের সাথে বলতেই হয় কথাটার সত্যতা প্রায় সর্বাংশে কালের কলঙ্কে চাপা পড়ে যাচ্ছে। চারপাশের অবস্থাদৃষ্টে শেখ সাদীর পোশাকের মূল্য কথাটাই মনে পড়ে। মুখ , মুখোশের অন্তরালে কুৎসিতকে কিছু মানুষ লালন করে পোশাকের চমৎকারিত্বে। করোনার ছোবলে লন্ডভন্ড ক্রন্দসী বিশ্ব দিগ্বিদিগ্জ্ঞান শূন্য , দিশেহারা মানুষ মৃত্যু আতঙ্কে কম্পমান ; একে একে হারাচ্ছেন প্রিয়জন - পরিজন , নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভেবে মানুষ প্রতিমূহুর্তে মানসিক - স্নায়বিক সমস্যায় উৎকন্ঠায় দিনাতিপাত করছেন। এরই মাঝে এক শ্রেণীর পোশাকী মানুষ মৃত্যুস্তুপ মাড়িয়ে জীবন জয়ের উল্লাসে মেতে সাধারণ মানুষকে বেঘোরে প্রতারিত করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছেন। লুটেরাদের যেনো বোধ বিবেচনা , মান - সম্মান , ন্যায় - নীতিবোধ , মানবিকতাবোধ কিছুই নেই। তারওপর কথায় বলে ---- বড়ো গলা । গত জুন মাসের (২০২০ ) প্রথম দিকে সরকারি তিতুমীর কলেজ কেন্দ্রিক তথাকথিত জেকেজি হেলথ কেয়ারের ন্যাক্কারজনক ঘটনার নায়িকা জেকেজির চেয়ারম্যান ডাঃ সাবরিনা আরিফ এবং তাঁর স্বামী প্রতিষ্ঠানটির সিইও মিঃ আরিফ চৌধুরীর করোনার ভূয়া নমুনা সনাক্ত , সার্টিফিকেট জালিয়াতির কুকীর্তি আজ দেশের গন্ডি ছাপিয়ে পুরো বিশ্বে আলোচনা - সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। চলছে পুলিশি তদন্ত , সরগরম গণমাধ্যম , উদ্বিগ্ন জনতা আর প্রতারিত সাধারণ জনগণ নাটকের শেষ দৃশ্যের জন্য অপেক্ষমান। অবশ্য, আজকের লিখাটি যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন জেকেজির চেয়ারম্যান ডাঃ সাবরিনা আরিফের গ্রেফতারের খবরে ফের চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে সারাদেশে - মিডিয়া জগতে।
অন্যদিকে বহুরুপী মোঃ সাহেদ করিম - চেয়ারম্যান রিজেন্ট হাসপাতাল লিঃ ; আরেক চমকপ্রদ গল্পের মহানায়ক হিসেবে হঠাৎই আবির্ভূত হয়েছেন। কী পরিচয় নেই তার , কোন ব্যবসা আর সম্পদের স্বল্পতা রয়েছে মিঃ সাহেদের। নারী- বাড়ি-গাড়ি ভুয়া চিকিৎসা, সার্টিফিকেট - নমুনা সনাক্তে জালিয়াতি, টর্চার সেলের গোপন কক্ষসহ সমাজের সম্মানিত মহলে মনস্তাত্বিক জালিয়াতি যার উদ্ভাবিত নব নব প্রেষণার পরিচায়ক । প্রতারণা করে করোনাভাইরাসের মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে গড়েছেন অর্থ, বিত্ত, মর্যাদা, মেকি আভিজাত্য আর চাকচিক্যের অভিধায় প্রজ্ঞার - অজ্ঞানতা । একখুরে মাথা কামানো জেকেজির সিইও মিঃ আরিফ দম্পতি এবং রিজেন্ট সাহেদ দম্পতি।
জেকেজি হেলথ কেয়ারের মিঃ আরিফ চৌধুরী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতনদের অজুহাত এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মিথ্যে প্রভাব খাটিয়ে ডাক্তার স্ত্রী সাবরিনাকে ব্যবহার করে সব অফিস আদালতে নিয়মিত দোর্দণ্ডপ্রতাপে কার্যোদ্ধার করে চলেছেন। মাদকসেবী আরিফ চৌধুরীর মাদকরাজ্যেও তার অবাধ বিচরণ ছিলো । শুধু তাই নয় , অশালীন প্রস্তাব দেয়ার কারণে খোদ জেকেজি হেলথ কেয়ারের এক স্বাস্হ্যকর্মী তাঁর বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা দায়ের করেছেন বলেও জানা যায়। সরকারি তিতুমীর কলেজ ক্যাম্পাসকে বিনোদন কেন্দ্র এবং পূর্ব পরিকল্পনামাফিক তিতুমীরের দুর্বল কর্মচারীদের ওপর শক্তির মহড়া দেখিয়েছেন। প্রভাব খাটিয়ে কয়েকটি টিভি চ্যানেলকে দিয়েও তাদের অসামাজিক কর্মকাণ্ডের সমর্থনে সচিত্র রিপোর্ট করিয়েছেন। নামকাওয়াস্তে শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে যুক্ত করেছিলেন ৭১ টিভির মতো একটি ঐতিহ্যিক টিভিতেও। দর্শক যারা সেদিনের কথোপকথন দেখেছেন তারা জানেন কীভাবে আমাকে তখন অসহযোগিতা করা হয়েছিলো। প্রকৃতির নিয়মে হোক আর সময়ের স্রোতেই হোক , অপরাধের আলামত কোনো না কোনোভাবে সত্যের স্মারক হয়ে থেকে যায়। যেমনটি ঘটেছে হুমায়ুন - তানজিনা দম্পতিকে জেকেজি থেকে বের করে দেয়ার ঘটনাটি।করোনা সনাক্তে ভূয়া রিপোর্ট আর জাল সার্টিফিকেটের বিষয়টি ওই দম্পতি জানতে পেরে অতিরিক্ত বেতন দাবি করলে ঘটে চলে মহা বিপর্যয় । কেঁচো খুঁড়তে সাপ নয় বেরিয়ে আসতে থাকে বড়ো অজগর। জব্দকৃত এক ল্যাপটপেই মেলে পনের হাজার ভূয়া সার্টিফিকেট। এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে গণমাধ্যমে সাবরিনার অসংলগ্ন - চাটুর্য্যপূর্ণ বক্তব্যে মিডিয়াকর্মীরাও বিস্মিত হন। সুযোগ বুঝে , অবস্থা বেগতিক দেখে অবশেষে ডা. সাবরিনা স্বাস্হ্য অধিদপ্তরের ডিজি , এডিজি মহোদয়ের নামটিও সামনে এনে করোনাকালীন সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছেন। নীতিহীন মানুষেরা এমনই হয় , এটাই তাদের স্থীর চরিত্র। মুখোশ খুলে ফেললে মানুষ আর মানুষ থাকে না ; মূহুর্তেই অমানুষ বনে যায় । দুর্বল বক আর ধূর্ত বাঘের গল্পটিকে এক্ষেত্রে বড়োই প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
জানা যায়, সর্বসাকুল্যে স্কুলের গন্ডি পেরোনো মোঃ সাহেদ নিজেকে কোন সে পথে কীভাবে সমাজে - রাষ্ট্রের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করলেন। নিয়মিত মিডিয়ার টক শোতে নীতিবাক্য আওড়ানো , বাংলা ইংরেজির মিশেলে কথা কপচানো , অর্থনীতি নিয়ে জ্ঞানগর্ভ কথা বলাতে জুড়ি নেই মিঃ সাহেদের। হ্যা তিনি এসব করতেই পারতেন , সমাজে সকলের সমীহ পেতেই পারতেন যদি না আড়ালের অপকর্মগুলির সাথে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা থাকতো। পৃথিবীতে অনেক মহান - ত্যাগী - আদর্শিক ব্যক্তিত্ব আজও রয়েছেন যাদের সার্টিফিকেটের বাড়াবাড়ি নেই । কিন্ত তেমনটি নয় , মিঃ সাহেদ, নামে - বেনামে , বাহারী নামে , উপাধির পরিধি বাড়িয়ে দাপটের সাথে ঘুরে বেরিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সচিবালয়ের অলিগলিতে। অসংখ্য মামলার আসামী হয়েও নিজের বিদ্যেবুদ্ধি আর অপকৌশলকে যথার্থভাবেই কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন দু’ দুটি হসপিটাল ,সাথে অবৈধ টাকার পাহাড়। র্্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন , রিজেন্ট হসপিটালের অনুমোদন ছয় বছর আগেই শেষ হয়েছে। উপরন্ত, হাসপাতালের মূল ভবনের মালিক ভাড়া চাইলেই নেমে আসতো হুমকি ধমকির খড়গ। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্হাকে এগিয়ে নেয়ার মানসে প্রতিষ্ঠা করেছেন বেশ ক" টি স্কুল কলেজ ; এম এল এম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকায় নিজের পকেট ভারী করেছেন। দৈনিক "নতুন কাগজ " নামে একটি পত্রিকা প্রকাশনার দায়িত্বেও রয়েছেন সাহেদ। সমাজে প্রভাব - প্রতিপত্তি - মর্যাদার অসম এক রাজ সিংহাসন তৈরি করে বিচরণ করেছেন অবাধে।র্্যাবের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, রিজেন্ট হাসপাতালে ১০ হাজার নমুনা টেস্টের মধ্যে ৪ হাজার ২৬৪টি বৈধ কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে করানো হয়েছে। বাকী ৬ হাজার করোনা রিপোর্ট কোনো বৈধ টেস্ট ছাড়াই দেওয়া হয়েছে ফলাফল ; অথচ নথি ঘেঁটে দেখা গিয়েছে , রিজেন্ট হাসপাতাল এ পর্যন্ত ২০০ কভিড রোগীর চিকিৎসা দিয়েছে এর বিপরীতে রিজেন্ট কর্তৃপক্ষ কভিড রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করেছে মর্মে সরকারের কাছে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার বেশি বিল জমা দিয়েছে । উল্লেখ্য, প্রতিটি ভুয়া টেস্ট রিপোর্টের জন্য তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা অসহায় রোগীদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে।
অনুমোদনহীন ওয়াকিটকি ব্যবহারসহ মিঃ সাহেদ বিলাসবহুল গাড়িতে ব্যবহার করতেন ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড এবং অস্ত্রধারী দেহরক্ষী। অবাক হতে হয় সাদৃশ্য দেখে ! চমৎকার মিল খুঁজে পাওয়া গেলো রিজেন্ট সাহেদের স্ত্রী এবং মি. আরিফ চৌধুরীর স্ত্রী ডাঃ সাবরিনার সাথে। দুজনেরই সহধর্মিণী এতো বিলাসী জীবন যাপনের পরেও তাঁদের প্রিয় স্বামীর অপরাধ তদন্ত সাপেক্ষে বিচার দাবি করেন।
ছবি তোলার সংস্কৃতিও ইদানিংকালে বিপদ বাড়াচ্ছে পদে পদে। দেশের বরেণ্য নামী দামী গুণী ব্যক্তিত্বদের ছবি তোলার ফাঁদে ফেলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছেন মি. সাহেদ। সুযোগ নিয়েছেন মিডিয়া ব্যক্তিত্বের, শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তার, গণমাধ্যম কর্মীসহ বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের। এসব সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের ছবি ব্যবহার করে কৌশলে নিজের ক্ষমতার দৌরাত্ম্য বুঝিয়ে দিয়ে বহুরুপী সাহেদ নিজ কার্য সমাধা করতেন অনায়াসে। নিজেকে পরিচয় করাতেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্য হিসেবে। যদিও বিষয়টি বিতর্কিত, দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও উপকমিটির সদস্য সচিব শাম্মী আহমেদ ১০ জুলাই জানান , ‘সাহেদ আমাদের কমিটির সদস্য নয় ।তাঁর নামে কখনোই কোনো চিঠি ইস্যু করা হয়নি।’
করোনার মহা বিপর্যয়ে ভঙ্গুর পৃথিবীতে আজ যে স্বাস্থ্যসেবার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেখানেই ঘটে চলেছে জীবন নিয়ে নয়-ছয়। মানুষ অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথরে রুপান্তরিত হয়। হতাশা নয় , বিস্ময়ও নয় এযেনো দুঃস্বপ্নে ভরা কোনো রুপকথার গল্প অথবা মাসুদ রানা সিরিজের দমবন্ধকর কোনো রহস্যময় অ্যাডভেঞ্চার । আধুনিক দার্শনিক হিউমের মতো করে একের পর এক রঙ্গমঞ্চে কুশীলবদের ঝকঝকে চকচকে আগমণ আবার সরবে - নিরবে প্রস্থঅন। স্বপ্নভঙ্গ হতেই ধপাস! গল্পের প্লট যেনো একই মুদ্রার এপিঠ - ওপিঠ। শুধু বিজ্ঞজনেরা কেনো সাধারণ জনগণও বিস্ময়াভিভূত।নামহীন মানহীন অখ্যাত অযোগ্য এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের প্রতিনিধিত্ব করার নাম করে কী অবলীলায় পৃথিবীর এমন এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একদিকে সরকারকে, সরকারের সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে অন্যদিকে জনগণকে সুকৌশলে প্রতারিত করে চলেছে। কী ধৃষ্টতা! কতো দুঃসাহস! কতো পাষন্ড এরা। ভদ্রবেশী এসব প্রতারক চক্রের জন্য বিদেশের মাটিতে নিজ দেশের সুনাম ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। ইতলির প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মানুষকে এক একটি ‘ভাইরাস বোমা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
যে দেশের প্রধানমন্ত্রী মহামারী সফলভাবে মোকাবেলার জন্য বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত হন , বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন বাংলাদেশকে রোল মডেল মনে করে ঠিক এমন একটি পর্যায়ে কিছু মানুষের অমানবিক স্বেচ্ছাচারীতা - হৃদয়হীনতা দেশের মানুষ তথা বিশ্ব বিবেকের কাছে কৈফিয়ত তলব করে। তবে আশার কথা, বঙ্গকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার সঠিক নির্দেশনা এবং প্রজ্ঞাপ্রসূত দূরদৃষ্টির কারণেই এসব অপকর্ম - অসঙ্গতি জনসমক্ষে বেরিয়ে আসছে ,কোনোরকম ঢাক ঢাক গুড় গুড় নয়; দিবালোকের মতোই সত্যকে উদ্ভাসিত করেছেন বঙ্গকন্যা। জনগণ আশা প্রকাশ করে , দেশরত্ন শেখ হাসিনার সুচিন্তিত বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তই পারে এসব প্রতারণা - জালিয়াতির সঠিক তদন্তপূর্বক অপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে। শুদ্ধি অভিযানের প্রত্যয়টিকে অধিকতর কার্যকরী করতে সরকার গৃহীত পদক্ষেপ জিরো টলারেন্সকে গতিশীলতা প্রদান এখন সময়ের দাবি॥
লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ ও সাধারণ সম্পাদক, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা
পূর্বপশ্চিমএনই
Post Written by :
Original Post URL : https://ift.tt/2Cvomys
Post Come trough : PURBOPOSHCIMBD