‘শ্রাবণের ধারার মতন’
মালিহা পারভীনছুটির দিনে মিরাজ একটু দেরি করেই হাঁটতে যায়। সকালের এই হাঁটাহাঁটিটা শরীরের সাথে সাথে তার মনটাকেও চনমনে রাখে সারাদিন। ক'দিন যাবত ঘুম ভেঙেই দেখতে পাচ্ছে আকাশের মুখ ভার, ছেঁড়া ছেঁড়া বৃষ্টি। শ্রাবণের বৃষ্টি বোধহয় এমনই বোঝা ভার। তার স্ত্রী নিরুপমার মতন।
নিরুপমার কথা মনে হতেই মিরাজের একটু অপরাধ বোধ হয়। বেচারা নিরুপমা সংসার সামলাতে যেয়ে নিজের জন্য সময় বের ক'রে উঠতে পারে না। আর কেমন যেন নিজের প্রতি খেয়ালও কম। কেমন মুটিয়ে যাচ্ছে ছিপছিপে শ্যামলা তন্বী সেই মেয়েটা। নাহ, এবার থেকে মাঝে মধ্যে নিরুপমাকে পার্কে হাঁটতে নিয়ে আসবে জোর করেই।
এইসব ভাবতেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। মিরাজ দৌড়ে পার্কের গেটের কাছে এক প্রশস্ত ছাউনির নিচে এসে দাঁড়ায়। দেখে আরো অনেকেই এখানে আশ্রয় নিয়েছে। ঝড়ো বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে ফুলবতী বোগেন ভেলিয়ার ঝাড়। বেশ শীত লাগছে। ও মাথার পানি ঝেড়ে ফেলে। ঝুম বৃস্টি নামে। মাঠের জমা জল নুড়ি, বালি, ঘাস ভাসিয়ে নিয়ে তিরতির স্রোতে পায়ের কাছে এসে জমছে। মিরাজ পা সরিয়ে একটু পিছনে যায়।
প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হলো কোথাও। এক মেয়েলি গলার চিৎকার শুনে মিরাজ তাকায় সেদিকে। দেখে মিরাজের পাশে অল্পবয়সি এক যুগল দাঁড়িয়ে। লম্বা একহারা গড়নের ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে। আর ছোটখাটো গড়নের ১৮-২০ বছরের সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ এক তরুণী ছেলেটার বুকে মাথা রেখে আছে। মেয়েটা ওর দু' হাত দিয়ে ছেলেটাকে আঁকড়ে ধ'রে আছে ভয়ে। মেয়েটার চুলে ছেলেটা ধীরে ধীরে আঙুল দিয়ে বিলি কেটে দিচ্ছে । কি মায়াময় অপার্থিব দৃশ্য! বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা শোভন নয়। মিরাজ দূরে গাছের ডালে বসা ভেজা কাক দেখতে থাকে।
ওর মনে পরে যায় নিরুপমার সাথে প্রেমের সেই দিনগুলির কথা। না, চোখে পরার মতন বিশেষ কিছুই ওদের কারোরই ছিল না। তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের দু ব্যাচ জুনিয়র নিরুপমার সাথে মিরাজের প্রেম হয়ে গেল। ওদের প্রথম দেখার দিনটাও ছিল এক ঝুম বৃষ্টি দুপুরে কার্জন হলের বারান্দায়।
আরেকটা দিনের কথাও বেশ মনে আছে। সবে তখন তিন মাস ওদের প্রেমের বয়স। বিশ্ববিদ্যালয় ঈদের ছুটিতে বন্ধ হয়ে গেছে। নিরুপমা পরদিন বাড়ি যাবে। তখনও মোবাইল আসেনি। কতোদিন কথা হবে না, দেখা হবে না। আগের রাতে মিরাজ দীর্ঘ এক চিঠি লিখে ফেলে । সকালে বাসস্ট্যন্ডে বিদায় দিতে যেয়ে নিরুপমার হাতে চিঠিটা দিয়ে আসবে ।
মিরাজ বাসস্ট্যান্ডে যেয়ে দেখে নিরুপমা আগে এসে জানালার ধারের সীটে বসেছে। মিরাজকে দেখে হাত নাড়ে ও। হাত দিয়ে কপালের চুল সরাতে সরাতে ওর দিকে তাকিয়ে নিরুপমা একটু হাসে। এই প্রথম মিরাজ খেয়াল করে হাসলে মেয়েটার গালে টোল পরে।
বাস চলতে শুরু করে দেয়। মিরাজের বুক হুহু করে উঠে। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়। কাক ভেজা হয়ে সেদিন ও বাড়ি ফিরে। চিঠিটা সেদিন আর নিরুপমাকে দেয়া হয়নি। প্যান্টের পকেটে থাকা চিঠিটা ভিজে লিখাগুলি প্রায় ঝাপসা হয়ে গেছে।
সেই প্রায় ২০ বছর আগের কথা। আজ এই রমনা পার্কে অচেনা প্রেমিক জুটি কত কথাই না মনে করিয়ে দিল। মেয়েটির গলা শোনা যায় : - আমি বৃষ্টির স্ট্যাটাস দিয়েছি - ‘এঞ্জয়িং রেইন’ -- আমি তোর আগেই দিয়ে দিয়েছি। ইটস রেইনিং, সো নাইস! দেখ কত লাইক কমেন্ট চলে এসেছে। ছেলেটার গলা।
মিরাজ আড়চোখে তাকায় ওদের দিকে। শুন্য ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আছে ওই জুটি। স্পর্শের কাছে। ওদের দুজনের চোখ মোবাইল স্ক্রিনে। আঙুল ব্যস্ত মোবাইল বাটনে।
আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। মিরাজ ছাউনি থেকে বের হয়ে বাসার দিকে পা বাড়ায়। নিরুপমা দরজা খুলে দেয়। এক হাতে কপালের চুল সরাতে সরাতে বলে মিরাজকে বলে : -- একেবারে বৃস্টি থামলেই আসতে। ভিজে গেছো তো। আজ তোমার তো আর অফিসে যাবার তাগাদা নেই।
মিরাজ তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে বলে - ওখানে আর দাঁড়াতে একদম ভাল লাগছিল না। আচ্ছা নিরু, তোমার কি মনে পরে বৃষ্টির দিনে আমরা ছাতা ভাঁজ করে ইচ্ছে ক’রে দোলাতে দোলাতে রাস্তায় ভিজতাম? লোকজন আমাদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতো।
নিরুপমা হেসে উঠে। রান্নাঘর থেকে খিচুরির ভুরভুর গন্ধ ভেসে আসছে। মিরাজের চোখ খুশিতে চকচক করে উঠে। - নিরু, আমাদের সেই বিখ্যাত বৃষ্টি ভেজা চিঠিটা কোথায়? -- আছে। ওটার তো শুধু সম্বোধনটুকু ছাড়া কিছুই পড়ার উপায় নেই। - নিয়ে আস না প্লিজ -- এই ব'লে মিরাজ ভিতরের ঘরে আসে।
আধবোজা জানালা দিয়ে হালকা বৃষ্টির ছাঁট আসছে। সুরমা রঙ আকাশ। ঘরের মধ্যে ছায়া ছায়া। ‘শ্রাবণের ধারার মতন’ গানটা শুনতে ইচ্ছে করে মিরাজের। ও মোবাইলের ইউ টিউবে গান খোঁজে।
নিরুপমা ঘরে ঢুকে। হাতে সেই বিবর্ণ চিঠিটি। : নাও তোমার সেই চিঠি। তবে আজ একটা কথা বলি। সেদিন তোমায় দিবার জন্য আমিওএকটা চিঠি লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম। বাসটা ছেড়ে দিল। তোমায় দিতে ভুলে গেলাম। বাড়ি যেয়ে বাবার ভয়ে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলতে হলো।
মিরাজের জানতে ইচ্ছে করে নিরুর ওই চিঠিতে কি ছিল। আবার মনে হয় না থাক। কিছু চিঠি থাক না পাওয়া থাক, কিছু কথা না পড়াই থাক। কিছু রহস্য থাকুক না! নিরুপমাকে কাছে টানে মিরাজ।
বিছানার এক প্রান্তে গড়াগড়ি যাচ্ছে মিরাজের লিখা ‘ওগো নিরুপমা’ সম্বোধনের সেই বৃষ্টি ধোঁয়া চিঠিটি।
রান্নাঘর থেকে খিচুরির পোড়া গন্ধ ভেসে আসে। বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘরে তখন প্রচণ্ড ঝড়!
লেখক: মালিহা পারভীন, সেগুনবাগিচা, ঢাকা।
পূর্বপশ্চিমবিডি/এসএস
Post Written by :
Original Post URL : https://ift.tt/2CJgdqD
Post Come trough : PURBOPOSHCIMBD