পাঁচ দিনের রিমান্ডে যা বললেন সাবরিনা
পূর্বপশ্চিম ডেস্কপাঁচ দিনের রিমান্ডে ডা. সাবরিনা চৌধুরী নিজের অপরাধ ও প্রতারণা কবুল করেছেন। দিয়েছেন অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানিয়েছেন তার প্রতারণার কাজে সহযোগীদের নাম। সাবরিনা ছাড়া তার স্বামী জেকেজি’র সিইও আরিফ চৌধুরীও তার অপরাধ কবুল করেছেন। ডিবি এখন তাদের দেয়া তথ্য যাচাই- বাছাই করে দেখছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ডা. সাবরিনা প্রথম থেকে জেকেজি’র সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করে আসছিলেন। রিমান্ডে এসেও তিনি তাই করেছেন। রিমান্ডের প্রথম দিকে সাবরিনা ও আরিফ একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়েছেন। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তাদের কৌশলী জিজ্ঞাসাবাদে শেষ পর্যন্ত দায় স্বীকার করেছেন। আরিফ চৌধুরীর চতুর্থ স্ত্রী দিনাজপুরের মেয়ে ডা. সাবরিনা চৌধুরী। আর সাবরিনার তৃতীয় স্বামী আরিফ চৌধুরী। সাবরিনার সঙ্গে বিয়ের পরেই আরিফ জেকেজি হেলথ কেয়ার নামের প্রতিষ্ঠানটি খুলেন। মূলত ওই প্রতিষ্ঠানটির কোনো বৈধতা ছিল না। তবে আরিফ চৌধুরীর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওভাল গ্রুপ জয়েন্ট স্টক থেকে রেজিস্ট্রেশন নেয়া ছিল। এই প্রতিষ্ঠানটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের কাজ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কাজ বাগিয়ে নিতে সাবরিনাই মূল ভূমিকা পালন করতেন। চিকিৎসক হওয়াতে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে তার জানাশোনা ছিল। অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্যতা ছিল। আর চিকিৎসক সমাজেও তার বেশ পরিচিতি ছিল। কাজ আদায়ে তিনি বিভিন্ন কৌশল বেছে নিতেন। যখন যে কাজে যাকে ব্যবহার করা দরকার ছিল তখন তাই করেছেন। করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর নমুনা সংগ্রহের আইডিয়া সাবরিনা আরিফের মাথায় আসে। রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহেদের সঙ্গে সাবরিনার আগে থেকেই ঘনিষ্ঠতা ছিল। শাহেদও করোনার নমুনা সংগ্রহের অনুমতি পেয়েছিলেন। তাই সাবরিনাও শাহেদের মতো নিজের প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথ কেয়ারের নামে নমুনা সংগ্রহের কাজ বাগিয়ে আনেন। ট্রেড লাইসেন্স নেই এমন একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ আনার ক্ষেত্রে তিনি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে ব্যবহার করেছেন। এছাড়া সহযোগিতা করেছেন সাবরিনার ঘনিষ্ঠ ও সরকার দলীয় চিকিৎসক সংগঠনের কয়েকজন নেতা। যাদের সঙ্গে সাবরিনা আর্থিক চুক্তি করে নিয়েছিলেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতারণার মিশন নিয়েই যোগসাজশ করে তারা মাঠে নেমেছিলেন। এজন্য কোনো বৈধ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া, নামমাত্র প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও তদারকি ছাড়াই তারা স্পর্শকাতর কাজটি পেয়েছিল। কাগজে কলমে ছিল শুধুমাত্র তিতুমীর কলেজে একটি মাত্র বুথ স্থাপন করে নমুনা সংগ্রহ করবে। কিন্তু তিতুমীর কলেজ থেকে যাত্রা শুরু করে তার অল্পদিনেই ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জ, সাভার, নরসিংদী ও গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে ৪০টি বুথ বসিয়ে মাঠকর্মী দিয়ে সংগ্রহ শুরু করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তাদেরকে কোনো টার্গেটও দেয়া হয়নি। তাই তারা গড়ে ৫০০-৬০০ নমুনা সংগ্রহ করতো। এসব নমুনা কোনো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে ফেলে দিতো। পরে গুলশানের কনফিডেন্স টাওয়ারের ১৬ তলার জেকেজি’র অফিস থেকে ইচ্ছামতো পজেটিভ নেগেটিভ রিপোর্ট দিতো। অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের কথা থাকলেও তারা প্রতিটি নমুনার বিপরীতে ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে আরো বেশি টাকা নিতো। বিদেশিদের কাছ থেকে ১০০ ডলার নিতো। এভাবে তারা রাতারাতি কয়েক কোটি টাকা বাগিয়ে নেয়। রিমান্ডে এসব বিষয় স্বীকার করেছেন তারা। এছাড়া তিতুমীর কলেজে বুথ বসিয়ে নমুনা সংগ্রহের নামে রাতভর মাদকতা, ডিজে, গান বাজনা বিষয়ে মুখ খুলেছেন। এসবের প্রতিবাদ করায় তারা তিতুমীর কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে সংবাদকর্মীদের ওপরও তারা হামলা চালিয়েছিল। এই দায়ও স্বীকার করেছেন।
ডিবি সূত্র জানায়, জেকেজির সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই দাবি করলেও ডজনখানেক প্রমাণ হাজির করা হয়। এসব থেকে প্রমাণিত হয় তার সম্পৃক্ততা ছিল। তিতুমীর কলেজে হামলার পর সাবরিনা সেখানে বক্তব্য দিয়েছেন। জেকেজি থেকে মাসে মাসে বেতন নেয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। জেকেজি’র চেয়ারম্যান হয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কথাও স্বীকার করেছেন সাবরিনা। রিমান্ডে সাবরিনা নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা না করে অবৈধভাবে জাল সনদ ও রিজেন্টের শাহেদের সঙ্গে তার আগে থেকেই পরিচয় থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
এদিকে, রিমান্ডে ডিবির জেরার মুখে সাবরিনা ও আরিফ তাদের সহযোগীদের নাম জানিয়েছেন। কারা তাদের কীভাবে সহযোগিতা করেছেন। বিনিময়ে তাদেরকে কি দিতে হয়েছে। ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টসূত্র জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে সাবরিনা ও আরিফ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে অন্তত আটজন কর্মকর্তার নাম বলেছেন। তাদের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সাবেক সচিব রয়েছেন। বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন দুইজন অতিরিক্ত সচিব। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন সর্বোচ্চ পদধারী ব্যক্তি রয়েছেন। অধিদপ্তরের একজন পরিচালক রয়েছেন যিনি হাসপাতাল-ক্লিনিকের দায়িত্বে আছেন। এর বাইরে পদধারী আরো দুজন কর্মকর্তা রয়েছেন। সাবরিনা চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) ও বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) চারজন চিকিৎসকের নাম বলেছেন। ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন চার্জশিটে সাবরিনার সহযোগী ও তাদের কার কি ভূমিকা ছিল এসব বিষয়ে উল্লেখ করা হবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হবে।
মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, পাঁচ দিনের রিমান্ডে সাবরিনার কাছ থেকে আমরা জানার চেষ্টা করেছি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া জেকেজি’র মতো প্রতিষ্ঠান কীভাবে কাজ পেয়েছে। কাজ পেতে তাদেরকে কারা সহযোগিতা করেছে। তাদের সঙ্গে কি ধরনের চুক্তি ছিল। যতটুকু নমুনা সংগ্রহের অনুমতি ছিল তার চেয়ে বেশি নমুনা কেন সংগ্রহ করেছে। এছাড়া জেকেজি’র করোনা সনদ দেয়ার অনুমতি না থাকলেও কেন তারা সনদ দিয়েছে।
বাতেন বলেন, সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরীকে আলাদাভাবে ও মুখোমুখি করে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের দুজনের কথাবার্তা ক্রসচেক করে দেখা হয়েছে। দুজনই তাদের সব অপরাধের কথা স্বীকার করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে সহযোগীদের নাম পেয়েছি। যারা তাদেরকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছে।
কারাগারে সাবরিনা
প্রতারণা মামলায় জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ও জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনা চৌধুরীর রিমান্ড শেষ হয়েছে। মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) কার্যালয়ে দুই দফায় পাঁচ দিনের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গতকাল তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করেছিলেন ডিবির তদন্ত কর্মকর্তা। তবে এদিন ডিবি নতুন করে সাবরিনার রিমান্ড আবেদন করেনি। আদালতে দেয়া প্রতিবেদনে ডিবি জানায়, রিমান্ডে সাবরিনার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে আবার তাকে রিমান্ডে আনার আবেদন করা হতে পারে। তাই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে রাখা প্রয়োজন। এ সময় সাবরিনার পক্ষে আদালতে জামিন আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষের শুনানি শেষে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলাম জামিনের আবেদন নাকচ করে সাবরিনাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া করোনার জাল সনদ দেয়ার অভিযোগে ২৩শে জুন সর্বপ্রথম জেকেজি’র দুই কর্মী হুমায়ুন কবির হিমু ও তার স্ত্রী তানজিনা পাটোয়ারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার দুইজনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গুলশানের কনফিডেন্ড টাওয়ারের ১৬ তলায় অভিযান চালিয়ে ২৫শে জুন গ্রেপ্তার করা হয় জেকেজি’র সিইও আরিফ চৌধুরীসহ আরো কয়েকজনকে। প্রতারণসহ আরো কিছু অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়। তারপর পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে জেকেজি’র একের পর এক প্রতারণার তথ্য। প্রতারণায় সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরীর। পরে ১২ই জুলাই সাবরিনাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পূর্বপশ্চিমবিডি/এসএস
Post Written by :
Original Post URL : https://ift.tt/2ZLRxqe
Post Come trough : PURBOPOSHCIMBD