বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় স্বপ্নের স্বাস্থ্যসেবা
খোলামত
সিমিন হোসেন রিমি১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসের ২ তারিখ সন্ধ্যায় উঁচু বারান্দা থেকে দ্রুতগতিতে নামতে গিয়ে আমার আম্মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের বাঁ পায়ের হাড় ভেঙে যায়। আব্বু তাজউদ্দীন আহমদ আম্মাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। আমার তখন খুব অল্প বয়স। আম্মার এই অবস্থায় আমার প্রচণ্ড অসহায় লাগতে থাকে। আম্মা যখন ফিরে এলেন, তখন জানতে পারলাম, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্লাস্টারের সরঞ্জাম নেই, তাই প্লাস্টার করা সম্ভব হয়নি। যন্ত্রণায় কাতর আম্মার মুখ এবং আমার শিশু মনের অসহায়ত্ব আজও মনে হলে আমাকে ভাবায়।
ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি চিকিৎসার জন্য বলতে গেলে সব সময় আমাদের বাসায় অসুস্থ মানুষের আসা-যাওয়া ছিল অবারিত। আমি তাদের জন্য দোয়া করতাম, সবাই যেন সুস্থ থাকেন। সেই অবুঝ সময়েও তাদের পাশে বসে বুঝতে চেষ্টা করতাম মানুষের অসুস্থতার বেদনা। সেই সময় ঢাকা এবং আশপাশের মানুষের একমাত্র ভরসা ছিল, ঢাকা মেডিকেল এবং মিটফোর্ড (সলিমুল্লাহ হাসপাতাল) হাসপাতাল। আর ছিল হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নে, যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সুষম বাংলাদেশের উপস্থিতি, সেখানে স্বাস্থ্য সেবা অন্যতম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের সময় মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত গুরুত্ব পায়। দুই বছরের মধ্যে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স (বর্তমান উপজেলা) নির্মাণ অগ্রাধিকার পায়। এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এত সুচিন্তিত ছিল, যেন সেই এলাকার মানুষ সেখানেই সবরকম চিকিৎসা পেতে পারেন। মেডিসিন থেকে গাইনি, সার্জারি, অর্থোপেডিকস, নাক-কান-গলা, হার্ট, চোখ, শিশু, দাঁতসহ প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি বিভাগের চিকিৎসা এবং চিকিৎসকের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। কেউ যদি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অর্গানোগ্রাম দেখেন, বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। আমার পরিস্কার মনে আছে, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে সকালে কাপাসিয়ায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চূড়ান্ত কাজ দেখতে যাওয়ার কথা ছিল আব্বুর।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং জেলে আটক জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য থেকে সরে যায় দেশ। স্বাস্থ্যসেবাও এর বাইরে নয়। মৌলিক প্রতিষ্ঠান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গুণগত মানের কোনো উন্নয়ন হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতিসহ সময়ের প্রয়োজনে নতুন বহুকিছুর সংযোজন ঘটেছে চিকিৎসা ক্ষেত্রে। কিন্তু বেচারা উপজেলা কমপ্লেক্স তার কোনো সুবিধাই অর্জন করতে পারেনি। উপজেলায় স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি প্যাথলজি নেই। যে কারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা এখানে সম্ভব হয় না যেমন- ব্লাড কালচার, ইলেকট্রোলাইট, লিপিড প্রোফাইল, ইউরিন কালচার ইত্যাদি। এ ছাড়া ব্লাড ব্যাংক নেই। কারও শরীরে রক্ত দিতে হলে এর জন্য যে স্ট্ক্রিনিং এবং ক্রস ম্যাচিং প্রয়োজন, তা হয় না। রেডিওলজি ডাক্তারের পদ না থাকায় এক্স-রে রিপোর্ট করা যায় না। আল্ট্রাসনোগ্রাম, বর্তমানে এই বিষয়টি যে কোনো ছোটখাটো ডাক্তারি পরীক্ষা কেন্দ্রে সম্ভব। কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আল্ট্রাসনোগ্রাফি হয় না। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, গত প্রায় সাড়ে তিন-চার বছর আগে উপজেলা পর্যায়ে আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর বিপরীতে সনোলজিস্ট নিয়োগ বা কোনো একজন মেডিকেল অফিসারকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এই কাজটি করার জন্য নিয়োগ বা নির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলে মেশিনগুলো বাক্সবন্দি হয়ে অব্যবহূত পড়ে আছে।
এ ছাড়া হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য যে পরিমাণ লোকবল দরকার তা উপজেলায় নেই। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দেশব্যাপী সমন্বিত বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন জরুরি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনায় সব বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিককে অন্তর্ভুক্ত রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে বিপন্ন পরিবেশ থেকে আমরা কেউ রক্ষা পাব না।
যুগের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য সেবার যে পরিবর্তন, সংযোজন হয়েছে তাতে বর্তমানে আমাদের দেশে আরও অনেক বেশি পরিমাণে সামঞ্জস্য প্রয়োজন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হলে এর অ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত বিশ্নেষণ করে উন্নত পর্যায়ে নিতে হবে। উপজেলা হলো সেই এলাকার মানুষের প্রাণকেন্দ্র- যেখানে প্রান্তিক মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ অর্থাৎ সব মানুষ যেন চিকিৎসার মতো মানবিক সেবা হাতের নাগালে পায় তার ব্যবস্থা রাখা একান্ত অপরিহার্য।
রাজধানী থেকে শুরু করে বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত চিকিৎসা কেন্দ্রের সব কেনাকাটার পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা, মানসম্মত জিনিসপত্রের কেনাকাটার নিশ্চয়তা ও প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক জিনিসটি সঠিক সময়ে নিশ্চিত করা ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে ক্রয় পদ্ধতি পরিবর্তন প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে একটি বিশেষ জাতীয় কমিটি এবং ধাপে ধাপে উপজেলা পর্যন্ত এই কমিটি বিস্তৃত হতে পারে। যেখানে বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন পর্যায়ের জনসম্পৃক্ততা থাকবে।
উপজেলা পর্যায়ে বেসরকারি ক্লিনিকগুলোর সার্বিক মানোন্নয়ন এবং যাচাই সংক্রান্ত একটি কমিটি আছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, কঠিন দেশপ্রেম, নিয়ম এবং দায়িত্বের প্রতি সর্বোচ্চ বিশ্বস্ততা এবং সেই এলাকার মানুষের নূ্যনতম সহযোগিতা ছাড়া এই পর্যায়ে যৌক্তিক কাজ করা প্রায় অসম্ভব। রাজধানীসহ বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সার্বিক মানোন্নয়ন এবং যাচাইয়ের জন্য স্তরে স্তরে মানসম্মত কমিটি করে কেন্দ্রীয়ভাবে স্বচ্ছতার মাধ্যমে মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা একান্ত প্রয়োজন। অনেক সময় দেখা যায় উপজেলা পর্যায়ে বেসরকারি ক্লিনিক অনুমোদন না পেলেও জেলা সিভিল সার্জন অফিস থেকে অনুমোদন নিয়ে আসে। অসুস্থতা একজন মানুষের জীবনের বড় একটি দুঃসময়। এই দুঃসময়ে সাধারণ মানুষ যেন লোভী, দুর্নীতিপরায়ণ কিছু মানুষের দ্বারা শারীরিক এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করার এখনই সময়। বিশেষভাবে টেকসই লক্ষ্যমাত্রা, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্য অর্জন করতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করা একান্ত জরুরি।
আমার ক্ষুদ্র চিন্তায় আরও মনে হয়, সরকারি যে কোনো পর্যায়ের হাসপাতালে বহির্বিভাগে সরাসরি টিকিটের টাকা জমা না নিয়ে তা যদি দ্রুতগতিতে ব্যাংকের মাধ্যমে জমা নেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়, তবে এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যেত। এ ছাড়া প্রতিটি হাসপাতালে অভ্যর্থনা এবং অনুসন্ধান কেন্দ্র স্থাপন করা গেলে সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে তার প্রয়োজন অনুযায়ী ডাক্তারের কাছে যেতে পারত, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাতে পারত, এতে একশ্রেণির দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধ হতো।
গত ২৮ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির দেওয়া ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবের নিয়মিত আলোচনায় আমি কাপাসিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নমূলক উদাহরণযোগ্য কিছু কার্যক্রমের কথা তুলে ধরি। সেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু করার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলাম। আগামীতে সারাদেশে স্বাস্থ্যবীমা চালু করা হলে সাধারণ মানুষ অনেকটা স্বস্তি পাবে। আরও একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চিকিৎসার জন্য দরিদ্র বেশ কিছু মানুষকে এককালীন ভালো অনুদান দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে এই অনুদানে সমাজসেবার সঙ্গে স্বাস্থ্য বিভাগের মাধ্যমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে যুক্ত করলে সরকার যে এত বড় অনুদান দিচ্ছে, তা মানুষ জানতে এবং বুঝতে পারত। প্রাপ্যতার দিক দিয়ে সঠিক মানুষটি নির্বাচন করা সহজ হতো।
বর্তমানে পুরো বিশ্ব এবং আমরা সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা এক সময় অতিক্রম করছি। এতদিন আমরা ইতিহাসে গল্প পড়েছি ভয়াবহ মহামারি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা। এখন তা নিরেট বাস্তবতা। কোনো দেশেরই প্রস্তুতির সুযোগ ছিল না। দীর্ঘদিনের জমে থাকা ত্রুটি-বিচ্যুতি তাই আমাদের সমাজকে নাড়া দিয়েছে বেশ খানিকটা। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আগামীর সুন্দরের স্বপ্ন দেখতে পারি। সংকটের সময়কে সুসময়ের পরিকল্পনায় কাজে লাগাতে হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনগণের জন্য গভীর ভালোবাসায় সিক্ত একটি মন আছে। তার সুদৃঢ় নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় স্বপ্নের স্বাস্থ্য সেবা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
লেখক: সংসদ সদস্য
পূর্বপশ্চিমবিডি/এসএস
Post Written by :
Original Post URL : https://ift.tt/39yt1Mv
Post Come trough : PURBOPOSHCIMBD