তাকসিমরা আছেন বলেই
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা‘বাহ! সমুদ্রের ঢেউ দেখছি ঢাকায় বসে, পয়সা খরচ করে যেতে হবে না কক্সবাজার’, ‘বিজয়নগর নদীর পানি বিপদসীমার দুই ফুট উপর দিয়ে বইছে’, ‘পৃথিবীতে এই প্রথম দেখা গেল দ্বিতল নদী’, ‘টাঙ্গুয়ার হাওর দেখতে যাব কেন, কাছেই মিরপুর হাওর আছে না? - মাঝারি মাত্রার বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়া ঢাকার নানা এলাকা আর মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের ছবি এবং ভিডিও পোস্ট করে তার সাথে নেটিজেনরা এই ধরনের মন্তব্য জুড়ে দিয়ে সয়লাব করে দিচ্ছেন ফেইসবুক।
টিকে থাকার ক্ষমতা মানুষকে এতদূর নিয়ে এসেছে। মানুষ প্রায় সব পরিস্থিতির সাথে নিজেকে অভিযোজিত করে ফেলতে পারে। সে কারণেই বাংলাদেশের মতো একটা দেশ যেখানে সবকিছু ভেঙে পড়েছে এমন একটা দেশেও মানুষ বেঁচে থাকে। আমরা এখন আমাদের যাপিত জীবনের যাবতীয় বীভৎসতা নিয়ে ট্রোল করি, মজা করি। এভাবেই আমরা বেঁচে থাকা শিখছি এই দেশে।
সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা এবং দুর্নীতির কারণে যখন করোনার মতো এক ভয়াবহ ব্যাধির মহামারিতে আমাদের জীবন সংশয়ে, তখন বৃষ্টিতে একটা তলিয়ে যাওয়া শহরের মাঝে দাঁড়িয়ে আমাদের মজা করারই কথা হয়তো। মানুষ ধরে নিয়েছে সবকিছু থেকে ক্রমাগত আরও খারাপের দিকে যাবে, তাই মেনে নেয়ার জন্য যা যা করা দরকার তাই করছে সবাই। বেঁচে থাকা সুন্দর, হোক সেটা নিকৃষ্টতম পরিস্থিতিতেও। পরবর্তী আলোচনায় যাবার আগে ওয়াসাকে নিয়ে একটা গবেষণা প্রতিবেদনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ দেখে নেয়া যাক।
গত বছর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ‘ঢাকা ওয়াসা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ঢাকা ওয়াসার পানির নিম্নমানের কারণে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে পান করেন। গৃহস্থালি পর্যায়ে পানি ফুটিয়ে পানের উপযোগী করতে প্রতি বছর আনুমানিক ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাসের অপচয় হয়।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায় বস্তি এলাকায় ৭১.৯ শতাংশ, আবাসিক এলাকায় ৪৫.৮ শতাংশ, বাণিজ্যিক এলাকায় ৩৪.৯ শতাংশ ও শিল্প এলাকায় ১৯ শতাংশ চাহিদা অনুযায়ী পানি পান না। এছাড়া সার্বিক সেবাগ্রহীতাদের ৪৪.৮ শতাংশ চাহিদা অনুযায়ী পানি পান না।
ওয়াসার অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, সেবাগ্রহীতাদের ৮৬.২ ভাগ ওয়াসার কর্মচারী এবং ১৫.৮ ভাগ দালালকে ঘুষ দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে পানির সংযোগ গ্রহণে ২০০ থেকে ৩০০০০ টাকা, পয়ঃলাইনের প্রতিবন্ধকতা অপসারণে ৩০০ থেকে ৪৫০০ টাকা, গাড়িতে করে জরুরি পানি সরবরাহ করার ক্ষেত্রে ২০০ থেকে ১৫০০ টাকা, মিটার ক্রয়/পরিবর্তন করতে ১০০০ থেকে ১৫০০০ টাকা, মিটার রিডিং ও বিল সংক্রান্ত বিষয়ে ৫০ থেকে ৩০০০ টাকা এবং গভীর নলকূপ স্থাপনে এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়।
যাচ্ছেতাই মানের পানি দেয়ার পরও গত ১২ বছরে অন্তত ১৩ বার পানির দাম বেড়েছে। ২০০৯ সালে যে পানির দাম ছিল পৌনে ৬ টাকা, এখন তা ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা। করোনার অভিঘাতে যখন অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছে, অসংখ্য মানুষ বেতন পাচ্ছে না তখন ওয়াসা ২৫ শতাংশ পানির দাম বাড়িয়েছে। ওদিকে অন্য কোনো নিরপেক্ষ সংস্থার হিসাবের কথা বাদই দেই, ওয়াসার হিসাবেই ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ এলাকা এখনও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার বাইরে।
আসা যাক ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার কথায়। কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে যখন ঢাকা শহর সমুদ্রে পরিণত হয়, তখন ওয়াসা থেকে জানানো হয় ঢাকার আশপাশে নদীতে পানি বেশি বলে পানি নিষ্কাশন দেরিতে হচ্ছে।
ডিএসসিসি মেয়র ২২ জুলাই সকালে এক ভার্চুয়াল সভায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, জলাবদ্ধতা নিয়ে সেবা সংস্থাগুলো যে তথ্য দিচ্ছে, তা সঠিক নয়। এরপর ঢাকার দুই মেয়র স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে নিয়ে সরেজমিনে পরিদর্শনে যান বিভিন্ন এলাকা। সেখানে গিয়ে মন্ত্রীকে তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন পানি নিষ্কাশনের পথে আবর্জনা ভরা, অনেকগুলো পথ বন্ধ করে রাখা হয়েছে ইত্যাদি।
দক্ষিণের মেয়র যথার্থভাবেই বলেন, ‘ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ওয়াসা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)। কিন্তু তারা এটি করতে ব্যর্থ হয়েছে।’ এরপর দুই মেয়র ওয়াসার হাতে থাকা খালগুলোর সংস্কারের এখতিয়ার সিটি কর্পোরেশনের অধীনে চান, কারণ উত্তরের মেয়র এর ভাষায়, ‘রাস্তায় পানি জমলে গালি আমাদের শুনতে হয়’।
আমাদেরও বলার কথা আছে অনেক। বাদ দেই সেগুলো। সরকারি দলের দুই মেয়র যখন ওয়াসাকে আপাদমস্তক ব্যর্থ বলছেন, তখন কী বলার থাকে আর?
তথাকথিত উন্নয়নের বয়ান তৈরি করার জন্য সরকার ক্ষমতায় থাকার ধারাবাহিকতার কথা বলে সব সময়। তারা বলে এক নাগাড়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় না থাকলে সব পরিকল্পনা ঠিকঠাকমতো বাস্তবায়ন করা যায় না। একেবারেই ভুল যুক্তি, কিন্তু এই তর্কে ঢুকছি না এখন। আলোচনার সুবিধার্থে ধরে নেই এটা সঠিক যুক্তি।
এই দেশে বর্তমান সরকার যতদিন ক্ষমতায় আছে, ওয়াসা এমডি ঠিক ততদিন তার পদে আছেন। এক দশকের বেশি সময় তিনি এবং তার সরকার ক্ষমতায় আছেন, কিন্তু এই ধারাবাহিকতা জনগণের কল্যাণ কোনো রকম প্রভাব রাখেনি। অবশ্য তিনি যে পদাসীন হচ্ছেন ‘ভিন্ন’ কোনো উদ্দেশ্যে সেটা তার নিয়োগ প্রক্রিয়া দেখেই অনেকটা বোঝা যাচ্ছিল।
এমডি নিয়োগের জন্য ওয়াসা বোর্ড ২০০৯ সালে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনে অথবা সিনিয়র পর্যায়ে সাধারণ প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ২০ বছরের আবশ্যিক অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। ওই সময় এই পদের জন্য তাকসিম এ খানের জমা দেয়া জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনে তার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। হ্যাঁ, ইন্টারভিউর ডাক পাবারও যোগ্যতা নেই এমন একজন এমডি পদের জন্য নির্বাচিত হলেন।
তাকসিম এ খান দায়িত্ব নেবার পর থেকেই ওয়াসার অধোগতি শুরু হয়েছে। সেবার মান কমেছে, ওয়াসা দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু এটা বাংলাদেশ, তাই অপসারিত হবার পরিবর্তে পুরষ্কৃত হয়েছেন তিনি, পর পর পাঁচবার ওয়াসার এমডি নিযুক্ত হয়েছেন। কোন ক্ষমতাবলে এটা হয়, এটা কি আমাদের অজানা?
সরকারি দল থেকে ‘নির্বাচিত’ মেয়ররা এখন যখন খুব শক্তভাবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন, তার ব্যর্থতার কথা বলছেন, হয়তো এই বছরের অক্টোবরে তার মেয়াদ শেষ হবার পর তাকে আর পুনর্নিয়োগ করা হবে না। ওয়াসা কি সুন্দরভাবে চলতে শুরু করবে এরপর? কিছুদিন আগে প্রচন্ড সমালোচনার মুখে যেমন সরিয়ে দেয়া হলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কি ঠিক হতে শুরু করবে তাতে?
একজন তাকসিম এ খান কে আমরা দেখতে পাই, তাই তাকে নির্দিষ্ট করে হয়তো আমরা কথা বলতে পারি। কিন্তু লুটপাট, অদক্ষতা অযোগ্যতা সবকিছু মিলিয়ে একটা শহরকে নরকে পরিণত করার পরও ওয়াসার দায়িত্বে দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় তাকে যারা রাখে তারা আরেকজন তাকসিমকেই বসাবেন এখানে। দুই কোটি মানুষের জীবনকে কিছুটা স্বাচ্ছন্দে রাখার চাইতে অন্য সব হিসেব-নিকেশ তাদের কাছে অনেক বেশি বড়।
একজনকে সরিয়ে আরেকজনকে বসানোর মাধ্যমে বরং সরকার এক ধরণের ‘আইওয়াশ’ দিতে পারে- তারা মানুষের কল্যাণে ব্যবস্থা নিচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকেই এখনকার ওয়াসা এমডির পদত্যাগ বা অপসারণ চাইলেও তার ‘শুভাকাঙ্খী' হয়ে আমি চাই তিনি পদে থাকুন আমৃত্যু। আমি জানি জনগণের প্রকৃত কল্যাণের সদিচ্ছা ছাড়া সমালোচনার কারণে তাকে সরানো আর না সরানোর মধ্যে বিন্দুমাত্র কোনো পার্থক্য নেই।
লেখক: সংসদ সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।
পূর্বপশ্চিমবিডি/এসএস
Post Written by :
Original Post URL : https://ift.tt/2BuccpC
Post Come trough : PURBOPOSHCIMBD