স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিতর্কিত কালো তালিকা, আইওয়াশের অভিযোগ
বিশেষ প্রতিনিধিসরকারি বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের যন্ত্রপাতি সরবরাহে দুর্নীতি-অনিয়মে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ১৪ ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সুপারিশে গত ৯ জুন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে পাঠানো এক চিঠিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে কালো তালিকাভুক্তির এই নির্দেশ দেওয়া হয়।
নির্দেশনা দেওয়ার ২৫ দিন পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়ে অগ্রগতি বা পরবর্তী সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিছুই জানাইনি। আর মিনা কার্টুনের টিয়া পাখির মতোই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিয়ে খালাশ। এর ফলোআপ কি, তা জনগণকে জানানোর প্রয়োজনও বোধ করছে না কিংবা আদৌ ফলোআপ হচ্ছে কিনা তাও নিশ্চিত নয়। এ অবস্থায় অভিযোগ ওঠেছে, লোক দেখাতেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই দুর্নীতির জন্য কালো তালিকাভুক্তি। এটি একধরনের আইওয়াশ ছাড়া আর কিছু নয়, এর আড়ালে ভাগাভাগি হচ্ছে শত কোটি টাকা।
অনেকেই বলছেন,শত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত অনেকেই প্রতিষ্ঠানের প্যাড আর ঠিকানা বদলে আগের মতই মালামাল সরবরাহ করে যাচ্ছে। ভাগাভাগি হচ্ছে শত কোটি টাকা। বেসরকারি টিভি চ্যানেল সময় সংবাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ে কালো তালিকাভুক্তির পরও রাজধানীর একটি বাসভবনে কাজ পরিচালনা করছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আহমেদ এন্টারপ্রাইজ ও অনিক এন্টারপ্রাইজ। এখনো সরঞ্জাম সরবরাহের কাজ যে পরিচালিত হচ্ছে তার প্রমাণ মেলে স্টোর রুমে আর প্রক্রিয়াধীন কিছু নথিপত্রে।
কালো তালিকাভুক্ত এই দুটি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এই একই পরিবারের আরোও ৩টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক মুন্সী ফররুখ ও তার আত্মীয়রা। সবগুলোই পরিচালিত হতো, ফররুখ আহমদের ভাই জাতীয় বক্ষব্যাধী হাসপাতালের সাবেক কর্মকর্তা মুন্সী সাজ্জাদ হোসেনের ছত্রছায়ায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮ -১৯ অর্থবছরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে আহমেদ ইন্টারপ্রাইজ ছাড়াও মেসার্স এ এস এল, মেসার্স আর সি এস এন্টারপ্রাইজ এর ঠিকাদারির মূল্যতালিকা দেখলে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। দুই অর্থ বছরে ঠিকাদারি এই তিনটি প্রতিষ্ঠান ১৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। যেখানে মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজ ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৯৫৪ হাজার টাকা , মেসার্স আর সিএস থেকে ১৬ কোটি ১১ লাখ টাকা, মেসার্স এ এস এল ১৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা কাজ পায় ৬ কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে।
স্বাস্থ্যখাত বিশেষজ্ঞ রশিদ ই মাহবুব বলেন, স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনায় সংস্কার দরকার। একই সাথে জবাবদিহিতার আওতায় যদি না আনেন ওই দুদক ইনকোয়ারি করবে অভিযুক্ত বের করবে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি হাসপাতালেই ঠিকাদারিতে ঘুরে ফিরে কাজ পাচ্ছেন নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান । যার মধ্যে ১৬ টির বিরুদ্ধেই কোনো না কোনো হাসপাতালের ঠিকাদারিতে অস্বাভাবিক মূল্যে সরঞ্জাম সরবরাহ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত। এই সিন্ডিকেটের যোগসাজশের অভিযোগে জড়িত অন্তত অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান রয়েছে দুদকের টেবিলে।
এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ই-টেন্ডারিংয়েও গড়মিল পাওয়া যায়, দুর্নীতি হয়। আমরা বলেছি ই-টেন্ডারিং সিস্টেম বা পিপিআর এগুলোর রিভিউ প্রয়োজন। যতই পরামর্শ করি না কেন আমাদের তদন্ত চলবে।
এছাড়াও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে ১২ টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ২৯১ কোটি টাকার যে কেনাকাটা ও যন্ত্রপাতি ক্রয় হয় যার ২শ’ কোটি টাকার কোনো হদিস পাওয়া যায় নি। ১৬-১৭ অর্থ বছরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ে ৩ হাজার কোটি টাকার কেনাকাটার বেশিরভাগেই দুর্নীতি হয়ছে। সব মিলে দেখা যায়, প্রতি অর্থবছরেই স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দের একটি বড় অংশ লোপাট হচ্ছে।
এর আগে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সুপারিশে গত ৯ জুন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপ-সচিব হাসান মাহমুদের স্বাক্ষরে এক চিঠিতে তাদেরকে কালো তালিকাভুক্ত করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়।
চিঠিতে সংশ্লিষ্ট ‘অসাধু’ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও মালিকদের বিরুদ্ধে দুদকে একাধিক মামলা থাকা এবং তাদের কালো তালিকা করতে দুদকের সুপারিশের কথা উল্লেখ করা হয়। যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে তারা হলেন-
রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল স্বত্বাধিকারী রুবিনা খানম। তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবরক্ষক মো. আবজাল হোসেনের স্ত্রী। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত প্রায় ২৮৫ কোটি টাকা পাচার এবং ৩৪ কোটি টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত বছর এই দম্পতির বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছিল দুদক।
এছাড়া মেসার্স অনিক ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আব্দুল্লাহ আল মামুন, মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজের মুন্সী ফররুখ হোসাইন, মেসার্স ম্যানিলা মেডিসিন অ্যান্ড মেসার্স এস কে ট্রেডার্সের মনজুর আহমেদ, এমএইচ ফার্মার মোসাদ্দেক হোসেন, মেসার্স অভি ড্রাগসের মো. জয়নাল আবেদীন, মেসার্স আলবিরা ফার্মেসির মো. আলমগীর হোসেন, এস এম ট্রেডার্সের মো. মিন্টু, মেসার্স মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মো. আব্দুস সাত্তার সরকার ও মো. আহসান হাবিব, বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিকেল কোম্পানির মো. জাহের উদ্দিন সরকার, ইউনিভার্সেল ট্রেড কর্পোরেশনের মো. আসাদুর রহমান, এ এস এলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আফতাব আহমেদ এবং ব্লেয়ার এভিয়েশনের মো. মোকছেদুল ইসলামকে কালো তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ওই সময় এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্ততরের মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান খান বলেছিলেন, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির দায়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করতে দুদক আমাদের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। আমরা সেটা অনুসন্ধান করে দেখব। কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটা এখনই বলতে পারব না।
কালো তালিকাভুক্তির নির্দেশনার চার সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেন, এখনও অনুসন্ধানের বিষয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে ফোন যোগাযোগ করে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি রেগে গিয়ে বলছেন, ফোনে এসব বিষয়ে কথা বলা সম্ভব না। সাক্ষাতে কথা বলার জন্য সময় দিতেও অপারগতা জানিয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলছেন, সময় হলে সবই জানতে পারবেন। অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানাও কথা বলতে রাজি না। এরই মধ্যে ফাঁস হলো, প্রতিষ্ঠানের নাম আর প্যাড বদলে লুটপাট চালিয়ে যাওয়ার নতুন কৌশল। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দূর্নীতি কালো তালিকার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
এ বিষয়ে বেসরকারি টিভি চ্যানেল সময় নিউজে প্রচার করা প্রতিবেদনটি নিচে দেওয়া হলো।
ভিডিও সৌজন্যে: সময় টিভি
পূর্বপশ্চিম-এনই
Post Written by :
Original Post URL : https://ift.tt/38zzeYb
Post Come trough : PURBOPOSHCIMBD