একজন স্বপ্নদ্রষ্টা ড. জুবেরী’র ভাবনা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা
মাহবুব সিদ্দিকীআজ ৬ই জুলাই। বাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৭ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। একজন মহান মানুষের স্বপ্নে কিভাবে দেশের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো, সে জন্যই এই লেখার অবতারণা।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি ড. ইতরাত হোসেন জুবেরী উত্তর ভারতের (উত্তর প্রদেশ) মায়াহারা নামক স্থানে সম্ভ্রান্ত মুসলিম উর্দুভাষী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ইতরাত হোসেন জুবেরী আগ্রা শহরের সেন্ট জোনস কলেজে লেখাপড়া শেষ করে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে এম.এ পাশ করেন। ১৯৩৫ সালে স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্য ও ইংরেজ কবি। ড. ইতরাত হোসেন জুবেরী তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩৭ সালে। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত সেখানে ইংরেজি বিভাগের রিডার পদে দায়িত্ব পালন করার পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মওলানা আবুল কালাম আজাদ কলেজ) ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে সিনিয়র প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪১ সালে উক্ত কলেজের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন এবং ১৯৪৭ অবধি এই পদে বহাল ছিলেন। শেরে বাংলা ফজলুল হক ছিলেন এই কলেজের পৃষ্ঠপোষক। ইতরাত হোসেন জুবেরী অনেক মেধাসম্পন্ন ছাত্রকে ইসলামিয়া কলেজে পড়াশুনা করার জন্য সুযোগ করে দিয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব উপাচার্য ড. মোসলেম হুদা কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যায়নকালে ইতরাত হোসেন জুবেরীর আহ্বানে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই কলেজে অধ্যয়নকালে সম্পূর্ণ সময়েই ইতরাত হোসেন জুবেরী ছিলেন অধ্যক্ষ। ইতিহাসের এরূপ একাধিক বিখ্যাত মানুষেরা সরাসরি ইতরাত হোসেন জুবেরীর ছাত্র ছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তানে এসে সিলেটের মুরারী চাঁদ কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করলেন। ১৯৫০ সালের ১০ এপ্রিল রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন।
১৯৫০ সালের ১৮ অক্টোবর সে সময়কার মেডিক্যাল স্কুলের এল.এম.এফ কোর্সে ভর্তির নির্বাচক কমিটির বৈঠক বসেছিল মেডিক্যাল স্কুলের পুরাতন একটি কক্ষে (বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রী নিবাস)। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ড. ইতরাত হোসেন জুবেরী, এম.এল.এ মাদারবক্স , রাজশাহীর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এমদাদ আলী, রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মনির উদ্দিন আকন্দ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আলোচনার এক পর্যায়ে প্রসঙ্গক্রমে ড. জুবেরী ইংগিত করলেন রাজশাহী কলেজে গভর্নমেন্ট যে গ্রান্ট দিয়ে থাকেন, এর সাথে মাত্র দেড় লক্ষ টাকা বা দুই লক্ষ টাকা অতিরিক্ত প্রদান করলে অনায়াসে রাজশাহীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব। ড. জুবেরীর এই কথাটি তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত সকলের মধ্যে নতুন একটি উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এর পর কেউ আর থেমে থাকলেন না। এ সংক্রান্ত পর পর কয়েকটি ঘরোয়া মিটিং অনুষ্ঠিত হলো। সকলের সম্বিলিত প্রচেষ্টায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের খসড়া রূপরেখা প্রস্তুত হলো। ৬৪ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য একটি শক্তিশালী কমিটি। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লা বাহার তিনদিনের সফরে রাজশাহীতে আসলে এখানকার নেতৃবৃন্দ রাজশাহীতে পূর্ণাঙ্গ একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবী উত্থাপন করলেন। মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আবেদনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন। জনাব মাদারবস উত্তর বঙ্গ এবং দক্ষিণ বঙ্গ সফর করে রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের স্বপক্ষে জনমত তৈরি করেন। ঢাকায় গিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে যোগাযোগ রেখে কাজ ত্বরান্বিত করেন। ড. জুবেরী স্থান নির্বাচন সহ বিশ্ববিদ্যালয় বিল প্রণয়ন ইত্যাদি প্রাথমিক কাজগুলো সমাপ্ত করেন।
১৯৫২ সালের ০১ নভেম্বর আইন পরিষদের স্পীকার আব্দুল হামিদ চৌধুরী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বিল উত্থাপন করেন। এই বিলটির চূড়ান্ত আলোচনার জন্য সিলেক্ট কমিটিতে না পাঠিয়ে সরাসরি আইন পরিষদে পাশ করানোর ব্যবস্থা করলেন মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন। এভাবে ৩১ মার্চ ১৯৫৩ সালোর বাজেট অধিবেশনে বিলটি পাশ হয় এবং ১লা জুলাই ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কার্যতঃ স্থাপিত হয়। ০৬ জুলাই ১৯৫৩ সাল থেকে ড. ইতরাত হোসেন জুবেরী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন।
১৯৫৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই পদে বহাল থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠে পরিণত করতে সক্ষম হন। একই বছর ০১ অক্টোবর থেকে পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে করাচিতে গমন করেন।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ড. ইতরাত হোসেন জুবেরী নানাবিধ গুণের অধিকারী ছিলেন। তাঁর সহযোগিতাকালে যেমন উত্তর প্রদেশ, বিহার ও কলকাতা থেকে আগত মোহাজের উর্দূভাষী পন্ডিত জনেরা (অধ্যাপক) রাজশাহী কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিলেন। পাশাপাশি দেশের বরেণ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষকবৃন্দ একযোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিলেন। ড. জুবেরী উর্দূভাষী হওয়া সত্বেও তৎকালীন ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে রাজশাহী কলেজ থেকে বহিস্কৃত অন্যতম ছাত্রনেতা মোহাম্মদ একরামুল হক কে পুনরায় লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে নিরপেক্ষ, উদার এবং ছাত্রদের প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ প্রদর্শনের মাধ্যমে সর্বকালের জন্য অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন। আজ রাজশাহী বাংলাদেশ তথা সার বিশ্বে শিক্ষা নগরী হিসেবে যে পরিচিতি পেয়েছে, তার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ড. ইতরাত হোসেন জুবেরীর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
Post Written by :
Original Post URL : https://ift.tt/31KWSzC
Post Come trough : PURBOPOSHCIMBD