এফআর টাওয়ারে আগুন: তদন্তেই বছর পার
মামুন খানবনানীর এফআর টাওয়ার। গত বছরের এই দিনে (২৮ মার্চ) ভবনটিতে আগুন লাগে। তাতে ঝরে যায় ২৭টি তাজা প্রাণ। নিহতদের পরিবার শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে।
ঘটনার পর পরই গঠিত হয় তদন্ত কমিটি, সব মহল থেকে আশ্বাস দেয়া হয় বিচারের। কিন্তু বিচার তো শুরুই হয়নি, এমনকি নিহতদের ময়না তদন্তও শেষ হয়নি।
দেশবাসীর স্মৃতি থেকে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষত মুছে গেলেও স্বজনহারা পরিবারগুলো বিচারের আশায় আদালতের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের আশা দ্রুতই মামলার বিচার শেষ হবে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত এক বছরেও শেষ হয়নি। কবে নাগাদ শেষ হবে বলতে পারছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
মামলাটিতে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এখন পর্যন্ত ১১ দফা সময় নিয়েছে তদন্ত সংস্থা ডিবি পুলিশ। সর্বশেষ গত ১২ মার্চ মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু ওই দিন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফজলুল হক প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেননি। এজন্য ঢাকা মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবদাস চন্দ্র অধিকারী আগামী ১৬ এপ্রিল প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের উত্তরের জোনাল টিমের পরিদর্শক ফজলুল হক বলেন, ‘মামলাটি এরআগে একজন তদন্ত করেছেন। এরপর আমি মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছি। তদন্ত চলছে। এখনও মৃত ব্যক্তিদের ময়নাতদন্ত শেষ হয়নি। আবার মামলার সাক্ষীও অনেক।’
কবে নাগাদ প্রতিবেদন দাখিল করা হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সঠিক করে বলতে পারছি না। তবে কাজ চলছে। যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করব।’
এফআর টাওয়ার ভবনের জমির মালিক প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুকের পুত্রবধূ অ্যাডভোকেট জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়া বলেন, ‘আমার শ্বশুর ঘটনার সাথে জড়িত নন। ওই টাওয়ারে তো আমাদেরও তিনটি ফ্লোর/অফিস আছে। আমরা সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করি। আগুন লাগায় আমাদেরও ক্ষতি হয়েছে। মালিক কি কখনো আগুন ধরিয়ে দেয়? আর আগুন লাগার কারণে আমরাও ভূক্তভোগী। আমার শ্বশুর দেশের একজন ফার্স্টক্লাস নাগরিক। সম্মানের সাথে তিনি সরকারি চাকরি শেষ করেছেন। উনার বয়স এখন ৭৬ বছর। এ বয়সে এসে তাকে জেলে যেতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘‘২০০৮ সালেও ওই ভবনে প্রথম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তখন আমার শ্বশুর ওই ভবনে অগ্নি নির্বাপনের ব্যবস্থা নেই জানিয়ে থানায় জিডি করেন। রাজউককেও জানিয়েছিলেন। তিনি ওই ভবনের অবৈধ নির্মাণকাজের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছিলেন। তারা কোনো অ্যা কশন নেননি।
‘ওই ভবনে গার্মেন্টস মালিক সেলিমউল্লাহর ফ্লোর থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। অথচ আমার শ্বশুরকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।”
সুষ্ঠু তদন্তে আসামিরা অব্যাহতি পাবেন বলে আশা করে জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়া বলেন, ‘দুর্ঘটনাবশত ভবনটিতে আগুন লেগেছে। পরবর্তীতে যেন আর এ ঘটনা না ঘটে এজন্য পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’
এফআর টাওয়ারের একটি অফিসের পিয়ন আবু সাঈদ। ঘটনার দিন তিনি টাওয়ারে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘১৮ তলায় আমার অফিস। সেখানেই ছিলাম। আগুন লাগার খবর পেয়ে বের হয়ে দেখি সিড়ি দিয়ে আগুন উপরে উঠছে। পরে আমরা ছাদে যাই। সেখানে অনেক মানুষ ছিল। সবাই বাঁচার জন্য আকুতি করছিল।
‘এফআর টাওয়ারের পাশেই আওলাদ সেন্টার। সেই ভবন দিয়ে নেমে যেতে সাহায্য করি তাদের। আওলাদ সেন্টারের মালিকও সেসময় এফআর টাওয়ারে ছিলেন। তাকেও নামিয়ে দেওয়া হয়। পরে আমিও আওলাদ সেন্টারে চলে যাই।”
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৮ মার্চ বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের পাশের ১৭১ নম্বর সড়কে ফারুক রূপায়ন (এফআর) টাওয়ারে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে ২৫ জন ও হাসপাতালে ১ জন নিহত হন। ওই ঘটনায় আহত হন ৭৩ জন।
এছাড়া একই ঘটনায় আহত হয়ে ফ্যায়ারম্যান সোহেল রানাও মারা যান। ওই ঘটনায় বনানী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ পরিদর্শক (এসআই) মিল্টন দত্ত ৩০ মার্চ বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
মামলায় ওই ভবনের ১৯ তলা থেকে ২৩ তলা পর্যন্ত বর্ধিত অংশের মালিক বিএনপি নেতা তাসভির উল ইসলাম, ভবনের জমির মালিক প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুক ও রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান ওরফে মুকুলকে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়। মামলায় অজ্ঞাতনামাদেরও আসামি করা হয়েছে।
মামলা দায়েরের পরই (৩০ মার্চ) বারিধারার নিজ বাসা থেকে তাসভির উল ইসলাম এবং বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ভবনের জমির মালিক প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন আদালত প্রত্যেকের (৩১ মার্চ) সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন । রিমান্ড শেষে ৯ এপ্রিল তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
গ্রেপ্তারের ১১ দিনের মাথায় মামলাটিতে গত বছর ১১ এপ্রিল জামিন পান তাসভিরুল ইসলাম। আর এক মাস ৫ দিন কারাভোগের পর গত বছর ৬মে মামলাটিতে জামিন পান ফারুক।
রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান ওরফে মুকুল গত বছর ২৩ জুন আত্মসমর্পণ করে জামিন পান।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের পরপরই বনানীর এফআর টাওয়ারের নকশা অনুমোদনে এস এম এইচ আই ফারুক হোসেন, লিয়াকত আলী খান মুকুল, তাসভির-উল-ইসলাম এবং রাজউকের সংশ্লিষ্ট ইমারত পরিদর্শকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
পরে নকশা জালিয়াতির মাধ্যমে অবৈধভাবে ১৬ থেকে ২৩ তলা ভবন নির্মাণের অভিযোগে এফআর টাওয়ারের মালিক, রাজউকের সাবেক দুই চেয়ারম্যান এবং রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৫ জুন পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে দুদক। দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ দুদকের উপ-পরিচালক আবুবকর সিদ্দিক বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
ভুয়া ছাড়পত্রের মাধ্যমে এফআর টাওয়ারের ১৯ তলা থেকে ২৩ তলা নির্মাণ, বন্ধক প্রদান ও বিক্রি করার অভিযোগে এবং টাওয়ারের ১৫ তলা অনুমোদন থাকলেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ১৯৯৬ লঙ্ঘন করে নকশা জালিয়াতির মাধ্যমে ১৮ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের অভিযোগ আনা হয় মামলা দুটিতে।
এফআর টাওয়ারকে ১৫ তলা পর্যন্ত নির্মাণে ইমারত বিধিমালা লঙ্ঘন এবং নকশা জালিয়াতির মাধ্যমে ১৮ তলা পর্যন্ত বাড়ানোর অভিযোগে ফারুক, লিয়াকত আলী খান মুকুল, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ূন খাদেম, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান ও সাবেক অথরাইজড অফিসার সৈয়দ মকবুল আহমেদকে অভিযুক্ত করে গত ২৯ অক্টোবর চার্জশিট দাখিল করা হয়।
হুমায়ূন খাদেম পলাতক থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। অপর ২০ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি তদন্তাধীন বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকা/মামুন খান/সনি