করোনায় মৃতের সৎকারে সমন্বয়হীনতা
সাহাদাত হোসেন পরশ'মনে হলো চাঁদের দেশ থেকে কেউ নেমে এলো। দেখতে ঠিক নভোচারীর মতো। গায়ের পোশাকসহ চোখের চশমাও সাদা রঙের। বিশেষ ধরনের এমন পোশাক পরেই গত বুধবার বিকেলে খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থানে অ্যাম্বুলেন্সে করে একটি লাশ নিয়ে হাজির হন এক চালক। তার সঙ্গে আর কেউ ছিলেন না। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও লাশ সৎকারের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট অন্য সংস্থার লোকজন না আসায় নিজেই ঝুঁকি নিয়ে সমাধিস্থ করেছি। পরে বাসার লোকজন বিষয়টি জানতে পারেন। তারা ফোন করে বাসায় ফিরতে নিষেধ করেন। এরপর থেকে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রয়েছি।' এভাবেই করোনা আক্রান্ত এক মৃতদেহ সৎকার করার অভিজ্ঞতা গতকাল বৃহস্পতিবার সমকালের কাছে তুলে ধরেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাখাওয়াত হোসেন শওকত। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর মৃতদেহের সৎকার নিয়ে সমন্বয়হীনতার প্রকট চিত্র উঠে এসেছে তার কথায়।
কাউন্সিলর শওকত জানান, করোনায় আক্রান্ত কেউ মারা গেলে তাকে সমাধিস্থ করার জন্য আগে থেকে প্রশাসনের লোকজন তালতলা কবরস্থান কর্তৃপক্ষকে খবর দেন। এলাকার কেউ যাতে কবর দেওয়া নিয়ে বিশৃঙ্খলা করতে না পারে তা দেখভাল করতে জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাউন্সিলরকে জানানো হয়। বুধবার খবর পেয়েই তালতলা কবরস্থানে কবর খোঁড়া চলছিল। মাগরিবের নামাজের আগেই কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে একটি লাশ আনা হয়। তবে অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে অন্য কোনো মেডিকেল টিম বা প্রশাসনের কেউ ছিল না। সবাই ভেবেছিল তারা হয়তো একটু পরই আসবেন। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হলেও কেউ না আসায় যারা কবর খুঁড়ছিলেন, ভয় পেয়ে যান তারা। এক পর্যায়ে শাবল-কোদাল রেখে পালিয়ে যান সবাই। এমন বাস্তবতায় যে চালক লাশটি বহন করে এনেছিলেন, বিপদে পড়ে যান তিনি।
শওকত আরও জানান, অ্যাম্বুলেন্স চালকের এমন দুরবস্থা দেখে ঝুঁকি নিয়ে অনেক নেতাকর্মীসহ লাশ দাফনের ব্যবস্থা করলাম। কবরস্থানের শেষ মাথায় কবর খোঁড়া হয়েছিল। সেখানে যাতে অ্যাম্বুলেন্সটি নেওয়া যায়, বাঁশ ফেলে সে ব্যবস্থা করি। এরপর কে কফিনটি ধরে কবরে মৃতদেহ রাখবে সেটা নিয়ে দেখা দেয় সংকট। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, যেহেতু অ্যাম্বুলেন্স চালকই বিশেষ পোশাক পরিহিত অবস্থায়, তাকেই অনুরোধ করলাম কফিনটি কবরে রাখার ব্যবস্থা করতে। পরে সাহস করে অ্যাম্বুলেন্স চালকই কফিনটি রাখার ব্যবস্থা করেন। অন্যরা সহায়তা করেন তাকে।
২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বলেন, ঝুঁকি নিয়ে এভাবে লাশ দাফন করা হলেও আমরা সংশ্নিষ্টদের ওপর বিরক্ত। যাদের দায়িত্ব ছিল লাশটি সঠিক নিয়ম মেনে দাফন করার, সেটা তারা করেনি। পুলিশসহ প্রশাসনের সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা কথা দিয়েছেন পরবর্তীকালে লাশ নিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হবে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি জামিল আহমেদ বলেন, 'বুধবার শুধু অ্যাম্বুলেন্সে করে একটি লাশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় পরও সংশ্নিষ্ট আর কেউ লাশটি দাফন করার জন্য আসেনি। পুলিশের কাছে সে ধরনের নিরাপত্তা সরঞ্জামও নেই যে তারা লাশ দাফন করতে পারবে। এছাড়া এ ধরনের লাশ পুলিশের দাফন করার কথাও নয়। পরে লাশটি দাফনের ব্যাপারে স্থানীয় কাউন্সিলর ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন।'
শওকত আরও বলেন, 'লাশটি দাফনের আগে ছোট পরিসরে জানাজা পড়ানো হয়। তবে বিপাকে পড়েছি আমি। বাসা থেকে 'ফাদার তেরেসা' উপাধি দিয়ে ১৪ দিন ঘরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে আমাকে। এখন একটি জায়গায় হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছি।'
নবনির্বাচিত এই কাউন্সিলর বলেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ তালতলা কবরস্থানে দাফন নিয়ে এলাকায় এক ধরনের অসন্তোষ রয়েছে। এলাকাবাসীর ভাষ্য, এখান থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। লাশ দাফন নিয়ে নানা গুজবও অনেকে বিশ্বাস করছেন। তবে সঠিক নিয়ম মেনে লাশ দাফন করলে ভয়ের কিছু নেই। এ ব্যাপারে এলাকার লোকজনকে সচেতন করা হচ্ছে।
ডিসি জামিল আহমেদ আরও জানান, বুধবারের ঘটনা ছাড়াও খিলগাঁওয়ে স্থানীয়দের বাধার মুখে আরেকটি লাশ তালতলা কবরস্থানে দাফন করা যায়নি। পরে সেটি অন্যত্র দাফন করা হয়েছে। করোনা আক্রান্তের পর মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ দাফনের ব্যাপারে আরও সমন্বয় থাকা দরকার।
সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতাল থেকে খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থান কাছে বলেই করোনা আক্রান্ত মৃতদেহ সেখানে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত হয়। অন্যান্য রোগেও প্রতিদিন ঢাকায় অনেকে মারা যাচ্ছেন। কারও আবার স্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছে। এসব লাশ যেসব কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়, করোনায় আক্রান্ত রোগীকে সেখানে কবর না দিয়ে অন্য কোনো একটি এলাকা নির্বাচনের জন্য পরামর্শ অনেকের। সেটা ঢাকার আশপাশে যে কোনো জায়গায় হতে পারে। এতে জনভীতি দূর করবে। এ ছাড়া কেউ কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর হটলাইনে সেবার জন্য যোগাযোগ করে কোনো প্রতিকার না পেলে তারা পুলিশকেও জানাচ্ছেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট ওই কর্মকর্তা যোগাযোগ করে সেবার ব্যবস্থা করবেন, এমন ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তাও নেই।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন কেউ মারা গেলে মৃতদেহ সরানো, পরিবহন, সৎকার বা দাফনের আগে অবশ্যই রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে (আইইডিসিআর) জানাতে হবে। এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী একটি প্রটোকল তৈরি করেছে আইইডিসিআর।
আইইডিসিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তিকে পরিস্কার করা, ধোয়া বা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছাড়া স্পর্শ করা যাবে না। চার সদস্যের একটি দল সুরক্ষা পোশাক পরে মৃতদেহ সৎকার বা দাফনের জন্য প্রস্তুত করবে। যেখানে তিনি মারা গেছেন, সেই জায়গায় প্লাস্টিক মুড়িয়ে মৃতদেহ রাখতে হবে। মৃত ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে তাদের কোনো অনুরোধ থাকলে জেনে নিতে হবে। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধে মরদেহ গোসল করানো যাবে না। তবে মরদেহ গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম বা পানি ছাড়া অজু করানো যাবে। সেলাইবিহীন সাদা সুতির কাপড় কাফনের কাপড় হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। ওই কাপড় প্লাস্টিকের ব্যাগে রেখে তার ওপর মরদেহ রাখতে হবে। ব্যাগের জিপার খোলা রাখা যাবে না। এ সময় যারা মরদেহ উঁচু করে ধরবেন, তাদের পরনে অবশ্যই সুরক্ষা পোশাক থাকবে।
মৃতদেহ সৎকারের জন্য মৃতদেহের সব ছিদ্রপথ (নাক, কান, পায়ুপথ) তুলা দিয়ে ভালো করে বন্ধ করে দেওয়া জরুরি। যাতে কোনো তরল গড়িয়ে পড়তে না পারে। এরপর সংক্ষিপ্ত রুটে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মৃতদেহ সমাধিস্থলে নিয়ে যেতে হবে। দাফনের পর মৃতদেহ বহনকারী ব্যাগটি কখনোই খোলা যাবে না। দাফনের পর কবর বা সমাধির স্থানটি ১০-১৫ সেন্টিমিটার গভীর মাটির স্তর দিয়ে ঢাকার পাশাপাশি দাফন করা স্থানের আশপাশ উপযুক্ত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিস্কার করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তি যে স্থানে মারা গেছেন, সেই স্থানটিও যত দ্রুত সম্ভব জীবাণুমুক্ত করা ও মৃতদেহ দাফনের পর সেই স্থান ভালোভাবে ঘিরে রাখতে বলা হয়েছে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করা যাবে না। মৃতদেহ পোড়ালে দেহাবশেষ বা ছাই থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায় না।
খিলগাঁওয়ের এক বাসিন্দা জানান, করোনা আক্রান্ত মৃতদেহ যাতে তালতলা কবরস্থানে দাফন না হয় সে ব্যাপারে এলাকায় মিছিল হয়েছিল। একটি লাশ তারা দাফন করতে দেননি। তবে দ্বিতীয় লাশটি দাফনের সময় এলাকাবাসী নীরব ছিল।
ডিএনসিসির প্রধান সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা তাজিনা সারোয়ার বলেন, 'বুধবারের ঘটনায় লাশ দাফনের ক্ষেত্রে কেবল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকজন ছিল না। তাদের তিন-চারজন থাকার কথা ছিল। যারা মূলত লাশটি ধরে কবরে রাখবেন। তালতলায় এ ধরনের লাশ দাফনের প্রথম ঘটনা হওয়ায় একটু সমন্বয়হীনতা ছিল। এর পুনরাবৃত্তি হবে না। তবে সিটি করপোরেশন ও পুলিশের লোকজন ছিল। পরে স্থানীয়রা লাশটি দাফন করে।'
তাজিনা সারোয়ার আরও বলেন, বুধবারের ঘটনায় মৃত ব্যক্তিকে প্রথমে মাদারীপুরে পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের কথা ছিল। পরে ফেরি বন্ধ থাকায় তাকে নেওয়া যায়নি। তার এক ছেলে গ্রামে কবর খুঁড়ে অপেক্ষায় ছিলেন। আরেক ছেলে ঢাকায় কোয়ারেন্টাইনে। সঠিকভাবে লাশ দাফন হলে সেখান থেকে ভাইরাস ছড়াবে না- সবাইকে বুঝতে হবে এটা। সূত্র: সমকাল।
পূর্বপশ্চিমবিডি/অ-ভি
করোনায় মৃতের সৎকারে সমন্বয়হীনতা
সাহাদাত হোসেন পরশ'মনে হলো চাঁদের দেশ থেকে কেউ নেমে এলো। দেখতে ঠিক নভোচারীর মতো। গায়ের পোশাকসহ চোখের চশমাও সাদা রঙের। বিশেষ ধরনের এমন পোশাক পরেই গত বুধবার বিকেলে খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থানে অ্যাম্বুলেন্সে করে একটি লাশ নিয়ে হাজির হন এক চালক। তার সঙ্গে আর কেউ ছিলেন না। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও লাশ সৎকারের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট অন্য সংস্থার লোকজন না আসায় নিজেই ঝুঁকি নিয়ে সমাধিস্থ করেছি। পরে বাসার লোকজন বিষয়টি জানতে পারেন। তারা ফোন করে বাসায় ফিরতে নিষেধ করেন। এরপর থেকে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রয়েছি।' এভাবেই করোনা আক্রান্ত এক মৃতদেহ সৎকার করার অভিজ্ঞতা গতকাল বৃহস্পতিবার সমকালের কাছে তুলে ধরেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাখাওয়াত হোসেন শওকত। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর মৃতদেহের সৎকার নিয়ে সমন্বয়হীনতার প্রকট চিত্র উঠে এসেছে তার কথায়।
কাউন্সিলর শওকত জানান, করোনায় আক্রান্ত কেউ মারা গেলে তাকে সমাধিস্থ করার জন্য আগে থেকে প্রশাসনের লোকজন তালতলা কবরস্থান কর্তৃপক্ষকে খবর দেন। এলাকার কেউ যাতে কবর দেওয়া নিয়ে বিশৃঙ্খলা করতে না পারে তা দেখভাল করতে জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাউন্সিলরকে জানানো হয়। বুধবার খবর পেয়েই তালতলা কবরস্থানে কবর খোঁড়া চলছিল। মাগরিবের নামাজের আগেই কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে একটি লাশ আনা হয়। তবে অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে অন্য কোনো মেডিকেল টিম বা প্রশাসনের কেউ ছিল না। সবাই ভেবেছিল তারা হয়তো একটু পরই আসবেন। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হলেও কেউ না আসায় যারা কবর খুঁড়ছিলেন, ভয় পেয়ে যান তারা। এক পর্যায়ে শাবল-কোদাল রেখে পালিয়ে যান সবাই। এমন বাস্তবতায় যে চালক লাশটি বহন করে এনেছিলেন, বিপদে পড়ে যান তিনি।
শওকত আরও জানান, অ্যাম্বুলেন্স চালকের এমন দুরবস্থা দেখে ঝুঁকি নিয়ে অনেক নেতাকর্মীসহ লাশ দাফনের ব্যবস্থা করলাম। কবরস্থানের শেষ মাথায় কবর খোঁড়া হয়েছিল। সেখানে যাতে অ্যাম্বুলেন্সটি নেওয়া যায়, বাঁশ ফেলে সে ব্যবস্থা করি। এরপর কে কফিনটি ধরে কবরে মৃতদেহ রাখবে সেটা নিয়ে দেখা দেয় সংকট। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, যেহেতু অ্যাম্বুলেন্স চালকই বিশেষ পোশাক পরিহিত অবস্থায়, তাকেই অনুরোধ করলাম কফিনটি কবরে রাখার ব্যবস্থা করতে। পরে সাহস করে অ্যাম্বুলেন্স চালকই কফিনটি রাখার ব্যবস্থা করেন। অন্যরা সহায়তা করেন তাকে।
২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বলেন, ঝুঁকি নিয়ে এভাবে লাশ দাফন করা হলেও আমরা সংশ্নিষ্টদের ওপর বিরক্ত। যাদের দায়িত্ব ছিল লাশটি সঠিক নিয়ম মেনে দাফন করার, সেটা তারা করেনি। পুলিশসহ প্রশাসনের সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা কথা দিয়েছেন পরবর্তীকালে লাশ নিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হবে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি জামিল আহমেদ বলেন, 'বুধবার শুধু অ্যাম্বুলেন্সে করে একটি লাশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় পরও সংশ্নিষ্ট আর কেউ লাশটি দাফন করার জন্য আসেনি। পুলিশের কাছে সে ধরনের নিরাপত্তা সরঞ্জামও নেই যে তারা লাশ দাফন করতে পারবে। এছাড়া এ ধরনের লাশ পুলিশের দাফন করার কথাও নয়। পরে লাশটি দাফনের ব্যাপারে স্থানীয় কাউন্সিলর ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন।'
শওকত আরও বলেন, 'লাশটি দাফনের আগে ছোট পরিসরে জানাজা পড়ানো হয়। তবে বিপাকে পড়েছি আমি। বাসা থেকে 'ফাদার তেরেসা' উপাধি দিয়ে ১৪ দিন ঘরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে আমাকে। এখন একটি জায়গায় হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছি।'
নবনির্বাচিত এই কাউন্সিলর বলেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ তালতলা কবরস্থানে দাফন নিয়ে এলাকায় এক ধরনের অসন্তোষ রয়েছে। এলাকাবাসীর ভাষ্য, এখান থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। লাশ দাফন নিয়ে নানা গুজবও অনেকে বিশ্বাস করছেন। তবে সঠিক নিয়ম মেনে লাশ দাফন করলে ভয়ের কিছু নেই। এ ব্যাপারে এলাকার লোকজনকে সচেতন করা হচ্ছে।
ডিসি জামিল আহমেদ আরও জানান, বুধবারের ঘটনা ছাড়াও খিলগাঁওয়ে স্থানীয়দের বাধার মুখে আরেকটি লাশ তালতলা কবরস্থানে দাফন করা যায়নি। পরে সেটি অন্যত্র দাফন করা হয়েছে। করোনা আক্রান্তের পর মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ দাফনের ব্যাপারে আরও সমন্বয় থাকা দরকার।
সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতাল থেকে খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থান কাছে বলেই করোনা আক্রান্ত মৃতদেহ সেখানে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত হয়। অন্যান্য রোগেও প্রতিদিন ঢাকায় অনেকে মারা যাচ্ছেন। কারও আবার স্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছে। এসব লাশ যেসব কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়, করোনায় আক্রান্ত রোগীকে সেখানে কবর না দিয়ে অন্য কোনো একটি এলাকা নির্বাচনের জন্য পরামর্শ অনেকের। সেটা ঢাকার আশপাশে যে কোনো জায়গায় হতে পারে। এতে জনভীতি দূর করবে। এ ছাড়া কেউ কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর হটলাইনে সেবার জন্য যোগাযোগ করে কোনো প্রতিকার না পেলে তারা পুলিশকেও জানাচ্ছেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট ওই কর্মকর্তা যোগাযোগ করে সেবার ব্যবস্থা করবেন, এমন ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তাও নেই।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন কেউ মারা গেলে মৃতদেহ সরানো, পরিবহন, সৎকার বা দাফনের আগে অবশ্যই রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে (আইইডিসিআর) জানাতে হবে। এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী একটি প্রটোকল তৈরি করেছে আইইডিসিআর।
আইইডিসিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তিকে পরিস্কার করা, ধোয়া বা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছাড়া স্পর্শ করা যাবে না। চার সদস্যের একটি দল সুরক্ষা পোশাক পরে মৃতদেহ সৎকার বা দাফনের জন্য প্রস্তুত করবে। যেখানে তিনি মারা গেছেন, সেই জায়গায় প্লাস্টিক মুড়িয়ে মৃতদেহ রাখতে হবে। মৃত ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে তাদের কোনো অনুরোধ থাকলে জেনে নিতে হবে। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধে মরদেহ গোসল করানো যাবে না। তবে মরদেহ গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম বা পানি ছাড়া অজু করানো যাবে। সেলাইবিহীন সাদা সুতির কাপড় কাফনের কাপড় হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। ওই কাপড় প্লাস্টিকের ব্যাগে রেখে তার ওপর মরদেহ রাখতে হবে। ব্যাগের জিপার খোলা রাখা যাবে না। এ সময় যারা মরদেহ উঁচু করে ধরবেন, তাদের পরনে অবশ্যই সুরক্ষা পোশাক থাকবে।
মৃতদেহ সৎকারের জন্য মৃতদেহের সব ছিদ্রপথ (নাক, কান, পায়ুপথ) তুলা দিয়ে ভালো করে বন্ধ করে দেওয়া জরুরি। যাতে কোনো তরল গড়িয়ে পড়তে না পারে। এরপর সংক্ষিপ্ত রুটে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মৃতদেহ সমাধিস্থলে নিয়ে যেতে হবে। দাফনের পর মৃতদেহ বহনকারী ব্যাগটি কখনোই খোলা যাবে না। দাফনের পর কবর বা সমাধির স্থানটি ১০-১৫ সেন্টিমিটার গভীর মাটির স্তর দিয়ে ঢাকার পাশাপাশি দাফন করা স্থানের আশপাশ উপযুক্ত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিস্কার করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তি যে স্থানে মারা গেছেন, সেই স্থানটিও যত দ্রুত সম্ভব জীবাণুমুক্ত করা ও মৃতদেহ দাফনের পর সেই স্থান ভালোভাবে ঘিরে রাখতে বলা হয়েছে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করা যাবে না। মৃতদেহ পোড়ালে দেহাবশেষ বা ছাই থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায় না।
খিলগাঁওয়ের এক বাসিন্দা জানান, করোনা আক্রান্ত মৃতদেহ যাতে তালতলা কবরস্থানে দাফন না হয় সে ব্যাপারে এলাকায় মিছিল হয়েছিল। একটি লাশ তারা দাফন করতে দেননি। তবে দ্বিতীয় লাশটি দাফনের সময় এলাকাবাসী নীরব ছিল।
ডিএনসিসির প্রধান সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা তাজিনা সারোয়ার বলেন, 'বুধবারের ঘটনায় লাশ দাফনের ক্ষেত্রে কেবল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকজন ছিল না। তাদের তিন-চারজন থাকার কথা ছিল। যারা মূলত লাশটি ধরে কবরে রাখবেন। তালতলায় এ ধরনের লাশ দাফনের প্রথম ঘটনা হওয়ায় একটু সমন্বয়হীনতা ছিল। এর পুনরাবৃত্তি হবে না। তবে সিটি করপোরেশন ও পুলিশের লোকজন ছিল। পরে স্থানীয়রা লাশটি দাফন করে।'
তাজিনা সারোয়ার আরও বলেন, বুধবারের ঘটনায় মৃত ব্যক্তিকে প্রথমে মাদারীপুরে পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের কথা ছিল। পরে ফেরি বন্ধ থাকায় তাকে নেওয়া যায়নি। তার এক ছেলে গ্রামে কবর খুঁড়ে অপেক্ষায় ছিলেন। আরেক ছেলে ঢাকায় কোয়ারেন্টাইনে। সঠিকভাবে লাশ দাফন হলে সেখান থেকে ভাইরাস ছড়াবে না- সবাইকে বুঝতে হবে এটা। সূত্র: সমকাল।
পূর্বপশ্চিমবিডি/অ-ভি