মানুষ নিজের ছায়ামূর্তিকেও ভয় পেতে শুরু করেছে আজকাল
অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরীপ্রিয় পৃথিবীর প্রশান্তির প্রিয় প্রান্তরে অশান্তির অশনিসংকেত আজ সর্বত্র হাতছানি দিয়ে চলেছে। শান্তির সুবাতাস বইছে না কোথাও, বিশুদ্ধ অক্সিজেনের আজ বড়ো অভাব। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, ভয়ার্ত ভয়াল থাবা গ্রাস করেছে মুখরিত পৃথিবীবাসীকে। সর্বত্রই নিস্তব্ধ-নিথর-পাথর সময় শোকস্তব্ধ মানুষের।
মানুষ নিজের ছায়ামূর্তিকেও ভয় পেতে শুরু করেছে আজকাল। ভালোবাসার পৃথিবীতে সারি সারি মৃত্যুর মিছিল।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারী থেকে বিশ্বমারীতে রুপ নিয়েছে। পৃথিবী হয়েছে চলমান মৃত্যু উপত্যকা, জনপদের পর জনপদ অঘোষিত বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। জীবনীশক্তি আজ শূন্যের কোঠায়। কোভিড-১৯ খ্যাত, নভেল করোনা খ্যাত প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিস্তার যেনো ঝড়ের বেগে হু হু করে বেড়ে চলেছে। অজানা, অচেনা, অদৃশ্য এক কণিকা যার দৃষ্টি নেই, শব্দ নেই, বোধ নেই, বিবেক নেই, নেই ঘ্রাণ, হাত পা কোনো কিছু। আছে শুধু সৃষ্টি আর বিস্তার। মুহূর্তেই কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণবায়ু। কতো অসহায় মানুষ! কতো অসহায় বিপুলা প্রাণের পৃথিবী।
গাণিতিক নয়, জ্যামিতিক হারে ভাইরাসটির বিস্তার ঘটছে। প্রতিনিয়ত ভাইরাসটি জিনের মিউটেশন (পরিবর্তন) ঘটাচ্ছে বিধায় চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারেও হিমশিম খাচ্ছেন। নভেল করোনা আবিষ্কৃত হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৩৮০ বার তার জিনের গঠন বদলেছে। সময় থমকে গিয়েছে ব্যস্ত কোলাহলমুখর বিশ্বের প্রতিটি শপিং মল থেকে বিনোদন পাড়া, অলিগলি থেকে রাজনীতি-অর্থনীতির সূচক থেকে উপাসনালয় পর্যন্ত। জনমানবহীন বিরানভূমি প্রতিটি রাষ্ট্র, প্রতিটি দেশ। স্বেচ্ছা লকডাউনের সংস্কৃতিতে নিপতিত পুরো বিশ্ব। ভেঙে পড়ছে ব্যবসা বাণিজ্য, উন্নয়ন অবকাঠামোসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান। বাঁচার তাগিদে লড়ছে সবাই। চীনের অভিশপ্ত উহানে উৎপক্তি হওয়া ভাইরাসটির গতি-প্রকৃতিও হেঁয়ালি-উদাসীন। কোনো স্থির চরিত্র নেই যেনো। সর্বত্র যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা। সকলে তৈরি হচ্ছে যুদ্ধ জয়ের তাগিদে। প্রথম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতার হৃদয় বিদারক ইতিহাস পড়েছি, জেনেছি কিন্ত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় হচ্ছে শুনতে শুনতে অবশেষে ভাইরাসজনিত তৃতীয় যুদ্ধও শুরু হয়ে গিয়েছে। বিদ্যমান পৃথিবীতে মানবসভ্যতা ভয়ানক অস্তিত্ব সংকটে আজ। বিশ্বের শীর্ষ নেতারা পারমাণবিক যুদ্ধের পরিবর্তে ভাইরাস যুদ্ধে একাট্টা হয়ে একযোগে এককাতারে থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন নভেল করোনা’র বিরুদ্ধে। পারমাণবিক অস্ত্রের সবধরনের মহড়াকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে আন্ধা এক অচেনা ভাইরাস। জমজমাট নির্ঘুম শহর-রাজপথ আক্ষেপে কাঁদছে, ঘুমিয়ে পড়েছে নয় এক দানবীয় আতঙ্কে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রুপকথার সোনার কাঠি রুপোর কাঠিতে নয় মৃত্যু কাঠির ভয়ঙ্কর স্পর্শে সারা পৃথিবী কাঁপছে। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে দিনকে দিন। চীন ছাপিয়ে ইতালি-স্পেন এখন নিস্তব্ধ মৃত্যুপুরী। ইতালির প্রধানমন্ত্রী Giuseppe Conte সব হারিয়ে নৈরাশ্যের সীমানায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আশান্বিত হচ্ছেন। করোনা চেনে না আপন-পর, শক্রু-বন্ধু, রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, কোনো ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত নির্বিশেষে।
৮ মার্চ প্রথম বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়েছে। তারপর থেকে চলছে সুরক্ষা-সতর্কতার নানামুখী প্রচারণা। ব্যক্তিগত পর্যায়ে, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীসহ আইইডিসিআর চব্বিশ ঘণ্টা করোনা সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে জনগণকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। হোম কোয়ারেন্টাইনে স্বেচ্ছা অন্তরীণ আজ অনিবার্য সময়ের দাবি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সর্বাবস্থায় সহযোগিতার আশ্বাস, তবুও জনমনে আতঙ্ক কী কাটছে? অদ্ভূত এক অচেনা আঁধার ঘিরে রেখেছে সকলের হৃদয় মন।
বড়ো কন্যা দুই নাতি ও জামাইসহ ইতালির রোমে বসবাস করছে। প্রতি মুহূর্তে খবর নিচ্ছি, ভিডিও কল এ কথা বলছি, সাহস দিচ্ছি তবুও আতঙ্ক কাটছে না মন থেকে। মেয়েটাকে আজ বড় বিষন্ন আর আতঙ্কিত মনে হলো। তখন থেকে মনটা কারোরই ভালো নেই। সবই আল্লাহ ভরসা। আতঙ্ক আজ পরিবারে, বন্ধু-স্বজনের জিজ্ঞাসিত চোখে-মুখে মনে। উচ্ছ্বাস নেই, উষ্ণতা নেই আছে শুধু অসহায় দীর্ঘশ্বাস।
তবুও আশা নিয়েই বাঁচে মানুষ। করোনাভাইরাসের আগেও পৃথিবীতে বহু মহামারী-বিশ্বমারী পূর্বপুরুষেরা প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রাচীন গ্রিসের "দ্য প্লেগ অব এথেন্স"-যেটাকে পৃথিবীর প্রথম প্লেগ মহামারীরুপে আখ্যায়িত করা হয়। যেটি ঘটেছিলো ৪৩০ খ্রী. গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডাইডসের "হিস্ট্রি অব দ্য পেলোপনেসিয়ান ওয়্যার" এর বর্ণনানুযায়ী এথেন্সের সেই প্লেগে হাজার হাজার সৈন্য মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
এছাড়াও প্রাচীন এথেন্সে টাইফয়েড, টাইফাস, গুটি বসন্ত, অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রাদুর্ভাবও ঘটেছিলো তবে মহামারী আকার ধারণ করেছিল গুটিবসন্ত। কখনও প্লেগ আকারে কখনও ইঁদুর বাহিত হয়ে ভাইরাস ছড়িয়ে প্রাণঘাতী মহামারী নিঃশব্দেই চলেছে। মৃত্যুবরণও করেছেন কোটি কোটি মানুষ। স্থায়িত্বের দিক থেকেও এসব মহামারী কখনও দশকের পর দশক আবার কখনও বা ৫০ বছর পর্যন্ত।
১৩৫১ সালে "ব্ল্যাক ডেথের" বিধ্বংসী তাণ্ডবলীলায় বলা হয়ে থাকে পুরো ইউরোপের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। গ্লোবাল বিশ্ব অর্থনীতি যতো সমৃদ্ধ হয়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে প্রাণঘাতী নতুন নতুন ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞান থেমে নেই, ফ্লু, গুটিবসন্ত, কলেরা, সার্স এর মতো ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিরুদ্ধেও আবিষ্কৃত হয়েছে ভ্যাকসিন।
ছোটোবেলায় শুনেছি ওলাবিবি ঢুকলে নাকি গ্রামের পর গ্রাম বসন্তে উজাড় হয়ে যেতো। দেখেছি, শুনেওছি, আমার মায়েরও নাকি ছোটোবেলায় সেরকম কঠিন গুটিবসন্ত হয়েছিল। কবিরাজের কথামতো আম্মাকে কলাপাতায় শুইয়ে রেখেছিল। ভয়ঙ্কর সেই মৃত্যু থাবা থেকে আল্লাহ আমার মাকে সুস্থ করে তুলেছিলেন বলেই আমরা তার সন্তান হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম। আজ সে অর্থে গুটিবসন্ত লোকসমাজে নেই বললেই চলে।
আমার ছোটোবেলার আর একটা করুণ ঘটনা আজ দুদিন ধরেই আবছা আবছা হয়ে বার বার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। তখন মনে হয় আমি দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। আমার জামালপুরের কাচারীপাড়ার বাসার পাশেই আর একটা নিম্নবিত্ত পরিবার বাস করতেন। পেশা হিসেবে তারা "সন পাপড়ি" বানিয়ে বিক্রি করতেন। সেই হাতে তৈরি "সন পাপড়ি" বানানোর যে শৈল্পিকতা সেটা আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। আমি সেই দম্পতিকে খালা-খালু বলে ডাকতাম। আমার বাবা আমাকে কোনো বাসায় যেতে দিতেন না। কিন্ত কথিত বাসাটি আমাদের ঘরের পাশেই হওয়ায় আব্বার অগোচরেই চলে যেতাম "সন পাপড়ি" বানানো দেখতে। চিনির ঘন সিরা থেকে বড়ো থালে নিয়ে ময়দা সহযোগে দুজনে থালের দুইপ্রান্ত থেকে টেনে টেনে ক্রস করে করে একসময় সেমাই এর মতো মিহি হয়ে ঝরঝরে সন পাপড়িতে পরিণত হতো। ওনারা আমাকে কন্যাসম মনে করতেন, আদর করে খেতেও দিতেন। সেই দম্পতির জ্যেষ্ঠ ছেলে সন্তান। বয়স ঠিক জানতাম না, তবে বয়সে তরুণ, সবাই তাকে "তৈমুছ" নামেই ডাকতো। যতোদূর মনে পড়ে বিয়ের জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছিলো তার। হঠাৎ করেই একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লো সে। পাড়ায় জানাজানি হয়ে গেল তৈমুছের কলেরা হয়েছে। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত বাড়তে থাকলো কিন্তু কিছুতেই কলেরা কমছিল না। তার বাবা মা কী চেষ্টা করেছেন, কতোটুকুন করেছেন সেটা জানার মতো বয়স তখন আমার ছিল না। তবে যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে সে রাত আমরা কাটিয়েছি সেটা মনে হয় কোনোদিনও ভোলা যাবে না। রাত যতো বাড়ছিল, ছেলেটি "পানি পানি" বলে কাতরাচ্ছিলো। নিস্তব্ধ রাতের সেই ভয়ংকর কাতরানোর শব্দ আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম। ওদিকে আমার আব্বা আম্মাকে দেখেছি ভয়ার্ত কণ্ঠে আমাদের চার ভাইবোনকে জড়িয়ে নিয়ে উচ্চস্বরে "সালামুন কাওলাম মিরাব্বি রাহিম" পড়তে। মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়েছি কিন্তু আতঙ্কিত হয়ে আব্বা আম্মার সেই দোয়া দরুদ পাঠের শব্দে আবার জেগে গিয়েছি। "মা পানি, মা পানি" শব্দ যতো শোনা যাচ্ছিল, আমাদের ভয়ও ততো বেড়ে চলেছিল। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য কেউ তাকে একফোঁটা পানি দিতে সাহস করেন নাই। অবশেষে ভোরের আজানের সময় সব বন্ধন ছিন্ন করে সে মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিয়েছিল। কী অসহায় নিয়তি!! কান্নার রোল!! আমরা ভয়ে জড়সড়!!
আজ আর সেই দিন নেই, কলেরা, গুটিবসন্তে এখন আর মড়ক নেই মহামারীও নেই। আধুনিক বিশ্বে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সফলতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তাই করোনা নিয়েও কোনো আতঙ্ক নয়। উৎকণ্ঠার পাশাপাশি সফলতার গল্পও কম নয়। শতবর্ষীরাও কোভিড-১৯ কে জয় করে জীবনে ফিরে এসেছে। নিজে সেরে উঠেছেন এবং অন্যদেরকেও আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। শুধুমাত্র মনোবল আর সচেতনতাই পারে অদৃশ্য এ যুদ্ধে জয়লাভ করার শক্তি যোগাতে।
ক্রিকেট কিংবদন্তী শচীন টেন্ডুলকার করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে তুলনা করেছেন টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে। এই ব্যাটিং জিনিয়াস বলেন, "টেস্টে দলকে জেতাতে হলে সবাই মিলে পারফর্ম করতে হবে। পার্টনারশীপ কিংবা টিমওয়ার্ক ছাড়া টেস্টে জয়লাভ করা যায় না। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সাফল্য পেতে হলে সবাই মিলে কাজ করতে হবে।"
ক্রিকেটের মতো সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন জরুরি নইলে একটু অসতর্ক হলেই সর্বক্ষেত্রে সর্বনাশ ঘটে যাবার সম্ভাবনা নিশ্চিত।
সর্বত্রই নিরাশার আঁধার এমনটি কিন্ত নয়। করোনাভাইরাসকে জয় করে সাফল্য বয়ে এনেছে এমন দেশের সংখ্যা স্বল্প হলেও আশা জাগানিয়া। দেশগুলো হচ্ছে-হংকং, ম্যাকাও, ভিয়েতনাম, রাশিয়া, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ সিঙ্গাপুরও রয়েছে এ তালিকায়।
সারাদেশ রয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণে জনগণকে আতঙ্কিত এবং ভীত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেসহ সকল বীর শহীদদের, যারা এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন। তিনি বলেন, দেশে কোনো খাদ্য ঘাটতি নেই, ওষুধ স্বল্পতাও নেই। অহেতুক গুজবে কান না দেয়ার জন্য জনগণকে আহ্বান জানান। চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ সব বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে মনিটরিং করছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তবুও বিশ্বজুড়ে চলছে অসম-অস্থির ভয়াবহ এক যুদ্ধ। প্রকাশ্য শক্রুকে চেনা যায়, প্রতিহতও করা যায়। চিরায়ত যুদ্ধের দামামা চলেছে-চলছে, জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে। কিন্ত নভেল করোনাভাইরাসের সাথে যুদ্ধ কোনো সাধারণ যুদ্ধ নয়, অদেখা-অচেনা শক্রর সাথে চলছে বিদগ্ধ যন্ত্রণাময় এক অন্তর্দ্বন্দ্ব। প্রাণের গ্রহ পৃথিবী আজ ভয়ানক অস্তিত্ব সংকটে। যুক্তিহীন কুসংস্কার, গুজব অস্থির মানবমনে মুহূর্তেই ছড়িয়ে জনজীবনকে করে তুলছে বিপন্ন, বিপর্যস্ত-পর্যুদস্ত। ভয়ার্ত মুখাবয়বে আতঙ্কের ছোঁয়া। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কে জানে, কার মাঝে গোপনে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি নভেল করোনা"।
তবুও, আশায় বাঁচে মানুষ। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা রাতদিন একাকার করে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারে। আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট দাবি করছে তারা যে টিকাটি আবিষ্কার করছেন সেটির কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য ৪৫ দিন সময় লাগবে। নতুন এই জীবনদায়ী টিকাটির নাম "এমআরএনএ-১২৭৩"। এটুকু অপেক্ষা তো আমরা বিশ্ববাসী করতেই পারি (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০ মার্চ ২০২০, ৭ চৈত্র ১৪২৬, পৃ: ০৫)।
বৈশ্বিক মহামারীর প্রেক্ষাপটে আপাততঃ জনজীবনে যে ছন্দপতন ঘটেছে তার উত্তরণ ঘটাতে জনগণকেই সচেতন হতে হবে সর্বাগ্রে। বৈশ্বিকভাবেই এর মোকাবেলা করতে হবে। মানবতার সীমানায় কোনোকিছুই আজ অন্তরায় নয়। মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁর রোষানল থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করুন। দোষারোপের সংস্কৃতি, মানুষকে হয়রানির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে এসে একসাথে একযোগে বাঁচার জন্য লড়তে হবে সকলকে।
প্রবাসীরা কোনো আতঙ্কের নাম নয়। ওরা আমাদেরই সন্তান, পরিবার, বন্ধু-স্বজন। ওদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ নয়, ওদের সুরক্ষায় চলুন প্রার্থনা করি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে। সহানুভূতির সাথে পাশে দাঁড়াই। আমাদের বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে তাঁদের পাঠানো রেমিটেন্স গতিশীল করেছে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে। সুতরাং রেমিটেন্স যোদ্ধাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর সহমর্মীতা সবসময় অব্যাহত থাকবে।
মৃত্যু আতঙ্ক যখন সর্বগ্রাসী হয়ে সকল দরজাতেই কড়া নাড়ছে তখন আর ভয় কীসের? চলুন, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে জ্বলে উঠি একবার। বৈপ্লবিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দৈহিক দূরত্ব বজায় রেখে, মানসিকভাবে কাছে থাকি, পাশে থাকি, সবাই সবাইকে সহযোগিতার মাধ্যমে করোনা দুর্যোগকে প্রতিহত করি। স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টাইনে থেকে সামাজিক সুরক্ষায় অংশগ্রহণ করে দেশ বাঁচাই, বিশ্ব বাঁচাই। বিপ্লবের অদৃশ্য আগুন জ্বলতে শুরু করেছে "করোনার বিরুদ্ধে" পুরো বিশ্বব্যাপী। অদৃশ্য জয় রথের দেখা মিলবেই একসময়। ততোক্ষণ আমরা ধৈর্য ধারণ করে কায়মনোবাক্যে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকি। তিনি নিশ্চয়ই মহা ক্ষমাশীল, মহান দয়ালু।
সকলের প্রত্যাশিত প্রাণের পৃথিবী আবারো কলকলিয়ে হেসে উঠবে। ডাকবে পাখি, গাইবে গান, ফুল-ফসলের মুখরতায় ভরবে আবার প্রতিপ্রাণ।সূত্র:বাংলাদেশ প্রতিদিন।
লেখক: অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী। সাধারণ সম্পাদক, শিক্ষক পরিষদ সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।
পূর্বপশ্চিমবিডি/জিএম
মানুষ নিজের ছায়ামূর্তিকেও ভয় পেতে শুরু করেছে আজকাল
অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরীপ্রিয় পৃথিবীর প্রশান্তির প্রিয় প্রান্তরে অশান্তির অশনিসংকেত আজ সর্বত্র হাতছানি দিয়ে চলেছে। শান্তির সুবাতাস বইছে না কোথাও, বিশুদ্ধ অক্সিজেনের আজ বড়ো অভাব। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, ভয়ার্ত ভয়াল থাবা গ্রাস করেছে মুখরিত পৃথিবীবাসীকে। সর্বত্রই নিস্তব্ধ-নিথর-পাথর সময় শোকস্তব্ধ মানুষের।
মানুষ নিজের ছায়ামূর্তিকেও ভয় পেতে শুরু করেছে আজকাল। ভালোবাসার পৃথিবীতে সারি সারি মৃত্যুর মিছিল।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারী থেকে বিশ্বমারীতে রুপ নিয়েছে। পৃথিবী হয়েছে চলমান মৃত্যু উপত্যকা, জনপদের পর জনপদ অঘোষিত বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। জীবনীশক্তি আজ শূন্যের কোঠায়। কোভিড-১৯ খ্যাত, নভেল করোনা খ্যাত প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিস্তার যেনো ঝড়ের বেগে হু হু করে বেড়ে চলেছে। অজানা, অচেনা, অদৃশ্য এক কণিকা যার দৃষ্টি নেই, শব্দ নেই, বোধ নেই, বিবেক নেই, নেই ঘ্রাণ, হাত পা কোনো কিছু। আছে শুধু সৃষ্টি আর বিস্তার। মুহূর্তেই কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণবায়ু। কতো অসহায় মানুষ! কতো অসহায় বিপুলা প্রাণের পৃথিবী।
গাণিতিক নয়, জ্যামিতিক হারে ভাইরাসটির বিস্তার ঘটছে। প্রতিনিয়ত ভাইরাসটি জিনের মিউটেশন (পরিবর্তন) ঘটাচ্ছে বিধায় চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারেও হিমশিম খাচ্ছেন। নভেল করোনা আবিষ্কৃত হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৩৮০ বার তার জিনের গঠন বদলেছে। সময় থমকে গিয়েছে ব্যস্ত কোলাহলমুখর বিশ্বের প্রতিটি শপিং মল থেকে বিনোদন পাড়া, অলিগলি থেকে রাজনীতি-অর্থনীতির সূচক থেকে উপাসনালয় পর্যন্ত। জনমানবহীন বিরানভূমি প্রতিটি রাষ্ট্র, প্রতিটি দেশ। স্বেচ্ছা লকডাউনের সংস্কৃতিতে নিপতিত পুরো বিশ্ব। ভেঙে পড়ছে ব্যবসা বাণিজ্য, উন্নয়ন অবকাঠামোসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান। বাঁচার তাগিদে লড়ছে সবাই। চীনের অভিশপ্ত উহানে উৎপক্তি হওয়া ভাইরাসটির গতি-প্রকৃতিও হেঁয়ালি-উদাসীন। কোনো স্থির চরিত্র নেই যেনো। সর্বত্র যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা। সকলে তৈরি হচ্ছে যুদ্ধ জয়ের তাগিদে। প্রথম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতার হৃদয় বিদারক ইতিহাস পড়েছি, জেনেছি কিন্ত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় হচ্ছে শুনতে শুনতে অবশেষে ভাইরাসজনিত তৃতীয় যুদ্ধও শুরু হয়ে গিয়েছে। বিদ্যমান পৃথিবীতে মানবসভ্যতা ভয়ানক অস্তিত্ব সংকটে আজ। বিশ্বের শীর্ষ নেতারা পারমাণবিক যুদ্ধের পরিবর্তে ভাইরাস যুদ্ধে একাট্টা হয়ে একযোগে এককাতারে থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন নভেল করোনা’র বিরুদ্ধে। পারমাণবিক অস্ত্রের সবধরনের মহড়াকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে আন্ধা এক অচেনা ভাইরাস। জমজমাট নির্ঘুম শহর-রাজপথ আক্ষেপে কাঁদছে, ঘুমিয়ে পড়েছে নয় এক দানবীয় আতঙ্কে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রুপকথার সোনার কাঠি রুপোর কাঠিতে নয় মৃত্যু কাঠির ভয়ঙ্কর স্পর্শে সারা পৃথিবী কাঁপছে। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে দিনকে দিন। চীন ছাপিয়ে ইতালি-স্পেন এখন নিস্তব্ধ মৃত্যুপুরী। ইতালির প্রধানমন্ত্রী Giuseppe Conte সব হারিয়ে নৈরাশ্যের সীমানায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আশান্বিত হচ্ছেন। করোনা চেনে না আপন-পর, শক্রু-বন্ধু, রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, কোনো ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত নির্বিশেষে।
৮ মার্চ প্রথম বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়েছে। তারপর থেকে চলছে সুরক্ষা-সতর্কতার নানামুখী প্রচারণা। ব্যক্তিগত পর্যায়ে, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীসহ আইইডিসিআর চব্বিশ ঘণ্টা করোনা সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে জনগণকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। হোম কোয়ারেন্টাইনে স্বেচ্ছা অন্তরীণ আজ অনিবার্য সময়ের দাবি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সর্বাবস্থায় সহযোগিতার আশ্বাস, তবুও জনমনে আতঙ্ক কী কাটছে? অদ্ভূত এক অচেনা আঁধার ঘিরে রেখেছে সকলের হৃদয় মন।
বড়ো কন্যা দুই নাতি ও জামাইসহ ইতালির রোমে বসবাস করছে। প্রতি মুহূর্তে খবর নিচ্ছি, ভিডিও কল এ কথা বলছি, সাহস দিচ্ছি তবুও আতঙ্ক কাটছে না মন থেকে। মেয়েটাকে আজ বড় বিষন্ন আর আতঙ্কিত মনে হলো। তখন থেকে মনটা কারোরই ভালো নেই। সবই আল্লাহ ভরসা। আতঙ্ক আজ পরিবারে, বন্ধু-স্বজনের জিজ্ঞাসিত চোখে-মুখে মনে। উচ্ছ্বাস নেই, উষ্ণতা নেই আছে শুধু অসহায় দীর্ঘশ্বাস।
তবুও আশা নিয়েই বাঁচে মানুষ। করোনাভাইরাসের আগেও পৃথিবীতে বহু মহামারী-বিশ্বমারী পূর্বপুরুষেরা প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রাচীন গ্রিসের "দ্য প্লেগ অব এথেন্স"-যেটাকে পৃথিবীর প্রথম প্লেগ মহামারীরুপে আখ্যায়িত করা হয়। যেটি ঘটেছিলো ৪৩০ খ্রী. গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডাইডসের "হিস্ট্রি অব দ্য পেলোপনেসিয়ান ওয়্যার" এর বর্ণনানুযায়ী এথেন্সের সেই প্লেগে হাজার হাজার সৈন্য মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
এছাড়াও প্রাচীন এথেন্সে টাইফয়েড, টাইফাস, গুটি বসন্ত, অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রাদুর্ভাবও ঘটেছিলো তবে মহামারী আকার ধারণ করেছিল গুটিবসন্ত। কখনও প্লেগ আকারে কখনও ইঁদুর বাহিত হয়ে ভাইরাস ছড়িয়ে প্রাণঘাতী মহামারী নিঃশব্দেই চলেছে। মৃত্যুবরণও করেছেন কোটি কোটি মানুষ। স্থায়িত্বের দিক থেকেও এসব মহামারী কখনও দশকের পর দশক আবার কখনও বা ৫০ বছর পর্যন্ত।
১৩৫১ সালে "ব্ল্যাক ডেথের" বিধ্বংসী তাণ্ডবলীলায় বলা হয়ে থাকে পুরো ইউরোপের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। গ্লোবাল বিশ্ব অর্থনীতি যতো সমৃদ্ধ হয়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে প্রাণঘাতী নতুন নতুন ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞান থেমে নেই, ফ্লু, গুটিবসন্ত, কলেরা, সার্স এর মতো ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিরুদ্ধেও আবিষ্কৃত হয়েছে ভ্যাকসিন।
ছোটোবেলায় শুনেছি ওলাবিবি ঢুকলে নাকি গ্রামের পর গ্রাম বসন্তে উজাড় হয়ে যেতো। দেখেছি, শুনেওছি, আমার মায়েরও নাকি ছোটোবেলায় সেরকম কঠিন গুটিবসন্ত হয়েছিল। কবিরাজের কথামতো আম্মাকে কলাপাতায় শুইয়ে রেখেছিল। ভয়ঙ্কর সেই মৃত্যু থাবা থেকে আল্লাহ আমার মাকে সুস্থ করে তুলেছিলেন বলেই আমরা তার সন্তান হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম। আজ সে অর্থে গুটিবসন্ত লোকসমাজে নেই বললেই চলে।
আমার ছোটোবেলার আর একটা করুণ ঘটনা আজ দুদিন ধরেই আবছা আবছা হয়ে বার বার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। তখন মনে হয় আমি দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। আমার জামালপুরের কাচারীপাড়ার বাসার পাশেই আর একটা নিম্নবিত্ত পরিবার বাস করতেন। পেশা হিসেবে তারা "সন পাপড়ি" বানিয়ে বিক্রি করতেন। সেই হাতে তৈরি "সন পাপড়ি" বানানোর যে শৈল্পিকতা সেটা আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। আমি সেই দম্পতিকে খালা-খালু বলে ডাকতাম। আমার বাবা আমাকে কোনো বাসায় যেতে দিতেন না। কিন্ত কথিত বাসাটি আমাদের ঘরের পাশেই হওয়ায় আব্বার অগোচরেই চলে যেতাম "সন পাপড়ি" বানানো দেখতে। চিনির ঘন সিরা থেকে বড়ো থালে নিয়ে ময়দা সহযোগে দুজনে থালের দুইপ্রান্ত থেকে টেনে টেনে ক্রস করে করে একসময় সেমাই এর মতো মিহি হয়ে ঝরঝরে সন পাপড়িতে পরিণত হতো। ওনারা আমাকে কন্যাসম মনে করতেন, আদর করে খেতেও দিতেন। সেই দম্পতির জ্যেষ্ঠ ছেলে সন্তান। বয়স ঠিক জানতাম না, তবে বয়সে তরুণ, সবাই তাকে "তৈমুছ" নামেই ডাকতো। যতোদূর মনে পড়ে বিয়ের জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছিলো তার। হঠাৎ করেই একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লো সে। পাড়ায় জানাজানি হয়ে গেল তৈমুছের কলেরা হয়েছে। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত বাড়তে থাকলো কিন্তু কিছুতেই কলেরা কমছিল না। তার বাবা মা কী চেষ্টা করেছেন, কতোটুকুন করেছেন সেটা জানার মতো বয়স তখন আমার ছিল না। তবে যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে সে রাত আমরা কাটিয়েছি সেটা মনে হয় কোনোদিনও ভোলা যাবে না। রাত যতো বাড়ছিল, ছেলেটি "পানি পানি" বলে কাতরাচ্ছিলো। নিস্তব্ধ রাতের সেই ভয়ংকর কাতরানোর শব্দ আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম। ওদিকে আমার আব্বা আম্মাকে দেখেছি ভয়ার্ত কণ্ঠে আমাদের চার ভাইবোনকে জড়িয়ে নিয়ে উচ্চস্বরে "সালামুন কাওলাম মিরাব্বি রাহিম" পড়তে। মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়েছি কিন্তু আতঙ্কিত হয়ে আব্বা আম্মার সেই দোয়া দরুদ পাঠের শব্দে আবার জেগে গিয়েছি। "মা পানি, মা পানি" শব্দ যতো শোনা যাচ্ছিল, আমাদের ভয়ও ততো বেড়ে চলেছিল। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য কেউ তাকে একফোঁটা পানি দিতে সাহস করেন নাই। অবশেষে ভোরের আজানের সময় সব বন্ধন ছিন্ন করে সে মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিয়েছিল। কী অসহায় নিয়তি!! কান্নার রোল!! আমরা ভয়ে জড়সড়!!
আজ আর সেই দিন নেই, কলেরা, গুটিবসন্তে এখন আর মড়ক নেই মহামারীও নেই। আধুনিক বিশ্বে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সফলতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তাই করোনা নিয়েও কোনো আতঙ্ক নয়। উৎকণ্ঠার পাশাপাশি সফলতার গল্পও কম নয়। শতবর্ষীরাও কোভিড-১৯ কে জয় করে জীবনে ফিরে এসেছে। নিজে সেরে উঠেছেন এবং অন্যদেরকেও আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। শুধুমাত্র মনোবল আর সচেতনতাই পারে অদৃশ্য এ যুদ্ধে জয়লাভ করার শক্তি যোগাতে।
ক্রিকেট কিংবদন্তী শচীন টেন্ডুলকার করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে তুলনা করেছেন টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে। এই ব্যাটিং জিনিয়াস বলেন, "টেস্টে দলকে জেতাতে হলে সবাই মিলে পারফর্ম করতে হবে। পার্টনারশীপ কিংবা টিমওয়ার্ক ছাড়া টেস্টে জয়লাভ করা যায় না। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সাফল্য পেতে হলে সবাই মিলে কাজ করতে হবে।"
ক্রিকেটের মতো সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন জরুরি নইলে একটু অসতর্ক হলেই সর্বক্ষেত্রে সর্বনাশ ঘটে যাবার সম্ভাবনা নিশ্চিত।
সর্বত্রই নিরাশার আঁধার এমনটি কিন্ত নয়। করোনাভাইরাসকে জয় করে সাফল্য বয়ে এনেছে এমন দেশের সংখ্যা স্বল্প হলেও আশা জাগানিয়া। দেশগুলো হচ্ছে-হংকং, ম্যাকাও, ভিয়েতনাম, রাশিয়া, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ সিঙ্গাপুরও রয়েছে এ তালিকায়।
সারাদেশ রয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণে জনগণকে আতঙ্কিত এবং ভীত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেসহ সকল বীর শহীদদের, যারা এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন। তিনি বলেন, দেশে কোনো খাদ্য ঘাটতি নেই, ওষুধ স্বল্পতাও নেই। অহেতুক গুজবে কান না দেয়ার জন্য জনগণকে আহ্বান জানান। চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ সব বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে মনিটরিং করছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তবুও বিশ্বজুড়ে চলছে অসম-অস্থির ভয়াবহ এক যুদ্ধ। প্রকাশ্য শক্রুকে চেনা যায়, প্রতিহতও করা যায়। চিরায়ত যুদ্ধের দামামা চলেছে-চলছে, জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে। কিন্ত নভেল করোনাভাইরাসের সাথে যুদ্ধ কোনো সাধারণ যুদ্ধ নয়, অদেখা-অচেনা শক্রর সাথে চলছে বিদগ্ধ যন্ত্রণাময় এক অন্তর্দ্বন্দ্ব। প্রাণের গ্রহ পৃথিবী আজ ভয়ানক অস্তিত্ব সংকটে। যুক্তিহীন কুসংস্কার, গুজব অস্থির মানবমনে মুহূর্তেই ছড়িয়ে জনজীবনকে করে তুলছে বিপন্ন, বিপর্যস্ত-পর্যুদস্ত। ভয়ার্ত মুখাবয়বে আতঙ্কের ছোঁয়া। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কে জানে, কার মাঝে গোপনে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি নভেল করোনা"।
তবুও, আশায় বাঁচে মানুষ। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা রাতদিন একাকার করে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারে। আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট দাবি করছে তারা যে টিকাটি আবিষ্কার করছেন সেটির কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য ৪৫ দিন সময় লাগবে। নতুন এই জীবনদায়ী টিকাটির নাম "এমআরএনএ-১২৭৩"। এটুকু অপেক্ষা তো আমরা বিশ্ববাসী করতেই পারি (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০ মার্চ ২০২০, ৭ চৈত্র ১৪২৬, পৃ: ০৫)।
বৈশ্বিক মহামারীর প্রেক্ষাপটে আপাততঃ জনজীবনে যে ছন্দপতন ঘটেছে তার উত্তরণ ঘটাতে জনগণকেই সচেতন হতে হবে সর্বাগ্রে। বৈশ্বিকভাবেই এর মোকাবেলা করতে হবে। মানবতার সীমানায় কোনোকিছুই আজ অন্তরায় নয়। মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁর রোষানল থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করুন। দোষারোপের সংস্কৃতি, মানুষকে হয়রানির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে এসে একসাথে একযোগে বাঁচার জন্য লড়তে হবে সকলকে।
প্রবাসীরা কোনো আতঙ্কের নাম নয়। ওরা আমাদেরই সন্তান, পরিবার, বন্ধু-স্বজন। ওদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ নয়, ওদের সুরক্ষায় চলুন প্রার্থনা করি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে। সহানুভূতির সাথে পাশে দাঁড়াই। আমাদের বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে তাঁদের পাঠানো রেমিটেন্স গতিশীল করেছে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে। সুতরাং রেমিটেন্স যোদ্ধাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর সহমর্মীতা সবসময় অব্যাহত থাকবে।
মৃত্যু আতঙ্ক যখন সর্বগ্রাসী হয়ে সকল দরজাতেই কড়া নাড়ছে তখন আর ভয় কীসের? চলুন, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে জ্বলে উঠি একবার। বৈপ্লবিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দৈহিক দূরত্ব বজায় রেখে, মানসিকভাবে কাছে থাকি, পাশে থাকি, সবাই সবাইকে সহযোগিতার মাধ্যমে করোনা দুর্যোগকে প্রতিহত করি। স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টাইনে থেকে সামাজিক সুরক্ষায় অংশগ্রহণ করে দেশ বাঁচাই, বিশ্ব বাঁচাই। বিপ্লবের অদৃশ্য আগুন জ্বলতে শুরু করেছে "করোনার বিরুদ্ধে" পুরো বিশ্বব্যাপী। অদৃশ্য জয় রথের দেখা মিলবেই একসময়। ততোক্ষণ আমরা ধৈর্য ধারণ করে কায়মনোবাক্যে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকি। তিনি নিশ্চয়ই মহা ক্ষমাশীল, মহান দয়ালু।
সকলের প্রত্যাশিত প্রাণের পৃথিবী আবারো কলকলিয়ে হেসে উঠবে। ডাকবে পাখি, গাইবে গান, ফুল-ফসলের মুখরতায় ভরবে আবার প্রতিপ্রাণ।সূত্র:বাংলাদেশ প্রতিদিন।
লেখক: অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী। সাধারণ সম্পাদক, শিক্ষক পরিষদ সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।
পূর্বপশ্চিমবিডি/জিএম