আয়ের উৎস হতে পারে মৌলভিত্তির কোম্পানিতে বিনিয়োগ
জাহাঙ্গীর আলম বকুলদেশে সব সময় কম-বেশি আলোচনায় থাকে পুঁজিবাজার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সময়ে সময়ে পুঁজিবাজার আলোচনায় আসে, কিন্তু আমাদের দেশে তা প্রায় বছরজুড়ে আলোচনায় থাকে। এর অন্যতম কারণ- পুঁজিবাজার নিয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক মৌলভিত্তির কোম্পানি না থাকা।
২০০৯-১০ সালের দিকে যখন পুঁজিবাজারের উত্থান হতে শুরু করে, তখন সূচক ছিল ২৩০০ পয়েন্টের কাছাকাছি। এরপর হু হু করে বেড়ে প্রায় ৯ হাজার পয়েন্টে ওঠে। সূচকের এই অস্বাভাবিক বাড়ার অর্থনৈতিক কারণ ছিল না। তখন ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে থাকে; সেই সুযোগ তখন ব্যাংকের ছিল। সেই সঙ্গে না জেনে-বুঝে, সহায়-সম্বল বিক্রি করে বিনিয়োগ করতে থাকে সাধারণ মানুষ। অথচ এতটা বিনিয়োগ ধারণ করার অবস্থা দেশের পুঁজিবাজারের ছিল না।
পুঁজিবাজারের আসল উদ্দেশ্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বরাবরই অনুধারণ করতে ব্যর্থ হন। তাদের অধিকাংশেরই পড়াশুনা বা অভিজ্ঞতা নেই। তাদের ধারণা, পুঁজিবাজার দিনে-দুপুরে কোটিপতি হওয়ার মেশিন। তারা অধিকাংশেই জানে না, যে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করছে, তা কেন করছে?
তারা জানার চেষ্টাও করে না, যে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করছে, সেই কোম্পানিটি তার বিনিয়োগের বিপরীতে কতটা মুনাফা দেওয়ার সামর্থ রাখে। সেখানে তার বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ!
একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, নামসর্বস্ব বহু কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অনেক কোম্পানি একটি শেয়ারের বিপরীতে একাধিক রাইট শেয়ার ছেড়ে শত শত কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। পরে ওইসব কোম্পানির পরিচালকদের হাতে থাকা অধিকাংশ শেয়ার সুকৌশলে ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন।
আবার পুঁজিবাজারে এমন নামসর্বস্ব বহু কোম্পানি রয়েছে, যাদের পরিচালকদের হাতে তেমন শেয়ার নেই; অথচ সেই কোম্পানির শেয়ার ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে। বছর শেষে কোম্পানিটি লোক দেখানো লভ্যাংশও ঘোষণা করে; যদিও সেটা বোনাস শেয়ারের লভ্যাংশ।
কোম্পানি সম্পর্কে না জেনে-বুঝে দ্রুত মুনাফার লক্ষ্যে ট্রেড করা (শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করে লাভ) যেমন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য আত্মঘাতী, তেমনি পুঁজিবাজারে তা অনিষ্ট ডেকে আনে। প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাজারের জন্য দরকার মৌলভিত্তির কোম্পানি এবং ম্যাচিউট বিনিয়োগকারী।
একটি মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি ব্যবসায়িক স্বার্থে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ নেবে এবং তা দিয়ে লাভ করে শেয়ারহোল্ডারদের ধারাবাহিক লভ্যাংশ দেবে; আর ম্যাচিউড বিনিয়োগকারীরা ওই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করবে, বছর শেষে ভালো মুনাফার আশায়; এমন কোম্পানি ও বিনিয়োগকারী দরকার।
এমন কোম্পানি ও বিনিয়োগকারী অবশ্যই আছে, তবে সেই সংখ্যা কম। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তিন শতাধিক কোম্পানি তালিকাভুক্ত আছে। কিন্তু ভালো নিট সম্পদ মূল্য (এনএভি), ধারাবাহিক ভালো মুনাফা দেওয়া ও ভালো ব্যবস্থাপনাসম্পন্ন কোম্পানি কয়টি আছে? ১৫-২০টির বেশি হবে না।
পুঁজিবাজারে মন্দা অবস্থায়, যেখানে ব্যাংকসহ বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে; সেখানে এই ১৫-২০টি কোম্পানির শেয়ার অভিহিত মূল্যের একশত গুণ, দেড়শত গুণ বা দুইশত গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানির খুব চাহিদা রয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে দাবি উঠেছে, দেশীয় বা বহুজাতিক এবং সরকারি ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনার। ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসলে সরকার ট্যাক্সে ছাড় দেয়। এ সুবিধা পাওয়ার পরও ইউনিলিভারের মতো বহু কোম্পানিকে সরকার পুঁজিবাজারে আনতে পারেনি। তবে সম্প্রতি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ।
পুঁজিবারে ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ নিরাপদ। ২০১০ সালে বড় ধস এবং এর পরবর্তী মন্দা অবস্থার মধ্যে কয়েকটি মৌলভিত্তির কোম্পানিতে (নাম উল্লেখ করলাম না) যারা বিনিয়োগ করে রেখেছিলেন; তাদের বিনিয়োগ নিরাপদ রয়েছে। উপরুন্ত প্রতিবছর ভালো লভ্যাংশ পেয়েছেন।
আমরা যারা সাধারণ মানুষ দিন আনি, দিন খাই, তাদের ওয়ালটনের মতো কোম্পানিতে বিনিয়োগের (অন্য কথায় মালিক হওয়ার, যদিও সেটা ক্ষুদ্রতম অংশের) সামর্থ নেই; যদি না সেটা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসলে, তাতে বিনিয়োগ করে সাধারণ মানুষের প্রতিবছর আয়ের একটা উৎস তৈরি হতে পারে।
ঢাকা/তানিম