

তিন বছরেও শেষ হয়নি ২ শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলার বিচার
মামুন খান২০১৭ সালের ২৮ মার্চ, রাজধানীর বনানী দি রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিনের উৎসবে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। ঘটনার তিন বছর পূর্ণ হলো পেরিয়ে গেলেও আজও মামলাটির বিচারকাজ শেষ হয়নি। দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হওয়া এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত হিসেবে আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ, তার বন্ধু সাদমান সাকিফ, দেহরক্ষী, চালক ও নাইম আশরাফের নাম উঠে আসে। এরপর থেকেই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবি ওঠে সর্বমহলে।
মূলত সাক্ষী হাজির না হওয়ার কারণে মামলাটির বিচার শেষ হচ্ছে না। কবে নাগাদ মামলাটির বিচারকাজ শেষ হবে নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহারের আদালতে এ মামলার বিচারকাজ চলছে। সর্বশেষ চলতি মাসের ২৩ মার্চ মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিন কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির হননি। এজন্য রাষ্ট্রপক্ষ সময় আবেদন করে। সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক ছুটিতে থাকায় ভারপ্রাপ্ত বিচারক আস সামছ জগলুল হোসেন আগামী ৭ মে পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেন।
সংশ্লিষ্ট আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর আফরোজা ফারহানা আহমেদ (অরেঞ্জ) বলেন, মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে আছে। এটি একটি আলোচিত মামলা। সত্যি বলতে, গুরুত্ব আনুযায়ী মামলাটি ওইভাবে শেষ করতে পারছি না। সাক্ষী না আসায় আইনি জটিলতার কারণে মামলাটির বিচার শেষ হচ্ছে না।
তিনি বলেন, মামলার দুই ভিকটিমের বন্ধু আহমেদ শাহরিয়ার। তাকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালত থেকে সমন পাঠানো হয়। তারপরও তিনি আদালতে হাজির হচ্ছেন না। তিনি আদালতে সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তার জবানবন্দি গ্রহণকারী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাক্ষ্য দিতে এলেও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা সাক্ষ্যগ্রহণ করাতে দিচ্ছেন না। তারা বলছেন, আগে শাহরিয়ারের সাক্ষ্য নেওয়া হোক। একারণে মামলাটির সাক্ষ্য হচ্ছে না। ফলে মামলাটি টেকনিক্যাল সমস্যায় পড়ে যায়। তা না হলে এতদিন রায়ের কাছাকাছি চলে যেত। আর করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিরও কিছুটা প্রভাব পড়বে। তারপরও আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করবো। আসামিদের যেন সর্বোচ্চ সাজা হয় এবং ভুক্তভোগী পরিবার যেন ন্যায়বিচার পায়।
বাদী পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, চাঞ্চল্যকর এ মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ হবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সাক্ষী না আসায় বিচার শেষ হচ্ছে না। আর আদালত চেঞ্জ হওয়ার প্রভাব কাজ করছে। তারপরও মামলাটি মোটামুটি গুছিয়ে এনেছি। আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিয়েছেন। আশা করছি আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হবে।
জামিনে থাকা চার আসামির আইনজীবী হেমায়েত উদ্দিন মোল্যা বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্য নয়। মামলাটির ট্রায়াল চলছে। আমরা ট্রায়াল ফেস করছি। ট্রায়ালের মাধ্যমে আসামিদের নিরাপরাধ প্রমাণ করতে সক্ষম হবো। আশা করছি, তারা খালাস পাবেন। আর তারা ন্যায়বিচার পাবেন।
কারাগারে থাকা নাইম আশরাফের আইনজীবী শিশির আলম খান বলেন, মামলার চার আসামি জামিন পেলেও নাইম আশরাফ জামিন পাচ্ছেন না। সবাই জামিন পেলে আমি (ক্লায়েন্ট) কেন জামিন পাবো না। জামিনের জন্য উচ্চ আদালতে যাবো। মামলাটি সেনসেটিভ। আর এ আদালতে থাকলে মামলাটিতে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড হবে। আমরা এ আদালতে ন্যায়বিচার পাবো বলে মনে হচ্ছে না। ট্রায়ালের জন্য আমরা উচ্চ আদালতের দিকে তাকিয়ে আছি।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাত ৯টা থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত আসামিরা মামলার বাদী এবং তার বান্ধবী ও বন্ধুকে আটকে রাখে। অস্ত্র দেখিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। বাদী ও তার বান্ধবীকে জোর করে একটি কক্ষে নিয়ে যায় আসামিরা। বাদীকে সাফাত আহমেদ ও তার বান্ধবীকে নাঈম আশরাফ একাধিকবার ধর্ষণ করে। আসামি সাদমান সাকিফকে দুই বছর ধরে চেনেন মামলার বাদী। তার মাধ্যমেই ঘটনার ১০-১৫ দিন আগে সাফাতের সঙ্গে দুই ছাত্রীর পরিচয় হয়।
এজাহারে আরও বলা হয়েছে, ওই দুই ছাত্রী সাফাতের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যান। সাফাতের গাড়িচালক ও দেহরক্ষী তাদের বনানীর ২৭ নম্বর রোডে রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে যায়। হোটেলে যাওয়ার আগে বাদী ও তার বান্ধবী জানতেন না যে সেখানে পার্টি হবে। তাদের বলা হয়েছিল, এটা একটা বড় অনুষ্ঠান, অনেক লোকজন থাকবে। অনুষ্ঠান হবে হোটেলের ছাদে। সেখানে যাওয়ার পর তারা কোনো ভদ্রলোককে দেখেননি। সেখানে আরো দুই তরুণী ছিল। বাদী ও তার বান্ধবী দেখেন সাফাত ও নাঈম ওই দুই তরুণীকে ছাদ থেকে নিচে নিয়ে যাচ্ছে। এ সময় বাদীর বন্ধু ও আরেক বান্ধবী ছাদে আসেন। পরিবেশ ভালো না লাগায় তারা চলে যেতে চান। এই সময় আসামিরা তাদের গাড়ির চাবি বাদীর বন্ধু শাহরিয়ারের কাছ থেকে নিয়ে নেন। বাদীকে খুব মারধর করা হয়। ধর্ষণ করার সময় সাফাত গাড়িচালককে ভিডিও ধারণ করতে বলেন। বাদীকে নাঈম আশরাফ মারধর করেন।
এরপর বাদী ও বান্ধবীর বাসায় রহমত আলীকে পাঠানো হয় তথ্য সংগ্রহের জন্য। তারা এতে ভয় পান। লোকলজ্জা এবং মানসিক অসুস্থতা কাটিয়ে উঠে পরে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলোচনা করে তারা মামলার সিদ্ধান্ত নেন। ৬ মে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়।
ওই বছর ৭ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এমি আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন।
চার্জশিটে আসামি সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ ওরফে এইচএম হালিমের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় সরাসরি ধর্ষণের অভিযোগ করা হয়।
সাফাত আহমেদের বন্ধু সাদমান সাকিফ, দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসনের বিরুদ্ধে আইনের ৩০ ধারায় ধর্ষণের সহযোগিতার অভিযোগ করা হয়।
২০১৭ সালের ১৩ জুলাই ট্রাইব্যুনাল আসামিদের অব্যাহতির আবেদন নামঞ্জুর করে চার্জ গঠন করেন। মামলাটিতে এখন পর্যন্ত ৪৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার দুই মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সত্যব্রত শিকদার ও খুরশীদ আলম সাক্ষ্য দেন। গত ছয় মাসে কোনো সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।
মামলাটিতে নাঈম আশরাফ বাদে অপর চার আসামি জামিনে আছেন। মামলাটিতে ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর সাফাত আহমেদের জামিন মঞ্জুর করেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি আদালত তার জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠান। গত বছর ৭ নভেম্বর আদালত ফের সাফাতের জামিন মঞ্জুর করেন।
এদিকে মামলাটিতে আসামিদের মধ্যে রহমত আলী ছাড়া অপর আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
ঢাকা/মামুন খান/এসএম/নাসিম