শিক্ষক আনিস কামালের জন্য কাঁদছে সুনমাগঞ্জ
আম্বিয়া নামের এক মহিলা কর্মচারী মুখ আঁচলে ঢেকে কাঁদছিলেন আর বিলাপ করছিলেন, ‘আল্লাহ অত বালা মানুষটারে তুমি অত তাড়াতাড়ি লইয়া গেলাগি, গত ১০ বছর আমি এই স্কুলো চাকুরি করি। কিন্তু এই মানুষটা আমারে মুখ কালা কইরা একটা কথা কইছে না, কোনোদিন অত বালা মানুষ গো আল্লাহ।’ বলে আবারও বিলাপ শুরু করেন।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধিসুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আম্বিয়া নামের এক মহিলা কর্মচারী মুখ আঁচলে ঢেকে কাঁদছিলেন আর বিলাপ করছিলেন, ‘আল্লাহ অত বালা মানুষটারে তুমি অত তাড়াতাড়ি লইয়া গেলাগি, গত ১০ বছর আমি এই স্কুলো চাকুরি করি। কিন্তু এই মানুষটা আমারে মুখ কালা কইরা একটা কথা কইছে না, কোনোদিন অত বালা মানুষ গো আল্লাহ।’ বলে আবারও বিলাপ শুরু করেন।
গত রোববার জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান কামালের (৪৫) মরদেহ জানাজার জন্য বিদ্যালয়ের সামনের মাঠে রাখা হলে প্রিয় স্যারকে শেষবারের জন্য দেখতে এসে বিদ্যালয়ের কর্মচারী আম্বিয়া এমন আকুতি করছিলেন। তবে শুধু আম্বিয়া নন, যাঁরাই জানাজায় অংশ নিতে আসেন, সবাই এমন করে আক্ষেপ করছিলেন। জানাজায় অংশ নেওয়া বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, সুধীসমাজ সবাই আনিস কামালের অকালে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছিলেন না।
গত ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে কিডনিজনিত জটিলতায় ৪৫ বছর বয়সে মারা যান আনিসুর রহমান কামাল। আর এই খবরে সুনামগঞ্জ শহরজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোক চলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও। কেউ বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, এত অল্প বয়সে তিনি চলে গেছেন।
আনিসুর রহমান কামাল সুনামগঞ্জ শহরের একজন ভদ্র বিনয়ী মানুষ ছিলেন। শহরের যাঁরা তাঁকে চিনতেন-জানতেন, সবাই একবাক্যে বলতেন তাঁর গুণের কথা। তিনি কারো সঙ্গে মুখ কালো করে কথা বলতেন না। নিজের ভেতরের কষ্ট-দুঃখ থাকলেও তিনি কাউকে তা বুঝতে দিতেন না। বরং সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন।
আনিসুর রহমান কামাল সুনামগঞ্জ শহরের দুটি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহকারী শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানের মতো দেখতেন। ভালোবাসতেন। আনিস কামাল একজন প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন। তিনি বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে ভালোবাসতেন। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নিজ গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। সেখানে তাঁর খামার করার ইচ্ছাও ছিল। আর জীবদ্দশায় তিনি সারাক্ষণ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নতি আর শিক্ষার মান কীভাবে বাড়ানো যায়, তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
সরকারি এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী ফারজিয়া হক ফারিন বলেন, ‘আনিস কামাল স্যার সম্পর্কে কী বলব, বুঝতে পারছি না। হঠাৎ এমন খবরে আঁতকে উঠেছিলাম, বারবার মনে হয়েছে খবরটা যেন ভুল হয়, স্যারের আরো সময় ছিল। স্যারের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা আরো অনেক কিছু শিখতে পারত, জানতে পারত। কিন্তু পরে খবরটা সত্যি হয়েছে, স্যার আর নেই।’
‘আনিস কামাল স্যার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন। একজন আদর্শ শিক্ষক বলতে যা বোঝায়, স্যার তাই ছিলেন। আমাদের যখন ক্লাস করাতেন, সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। স্যার গতানুগতিক পড়ালেখার বাইরে এসে অনেক সহজ করে পড়াতেন। স্যার আমাদের স্কুলের পড়ালেখার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলা করতে বেশি উৎসাহ দিতেন। একবার ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটি দল আমাদের স্কুল ভিজিট করতে এসেছিল, তখন আমরা নিজেরা একটি নাটক বানিয়েছিলাম। স্যার নাটক দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। আনিস কামাল স্যার আমার সম্পর্কে মামা ছিলেন। তিনি মেয়েদের নিজের সন্তানের মতো আচরণ করতেন।’
আনিস কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অ্যাডভোকেট এনাম আহমদ বলেন, ১৯৮২ সালে সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস থ্রিতে ভর্তির সুবাদে কামালের সঙ্গে পরিচয়। আনিস কামাল ক্লাস ফোর থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত এক নাম্বার ছিল। সে কখনো দ্বিতীয় হয়নি। আমাদের সাথে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স করে। এর পর সরকারি এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়। ওই সময়ে তাঁর বিদেশে যাওয়ার ভালো সুযোগ-সুবিধা ছিল, উন্নত জীবনযাপনের অনেক সুবিধা ছিল। কিন্তু সে আর যায়নি। মা-বাবার সঙ্গে দেশে থেকেছে। আনিস কামাল সব সময় অন্তর্মুখী ছিল, প্রচারে বিমুখ ছিল। সে কাউকে কোনো হেল্প করলে নীরবে করত। কেউ জানতে পারত না।
আনিস কামালের দীর্ঘদিনের সহকর্মী সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এ কে এম আজাদ বলেন, ‘একজন ভদ্র মানুষ বলতে যা বোঝায়, কামাল তাই ছিল। বর্তমান সময়ে যখন শিক্ষার্থীদের ক্লাসে মনোযোগী করা কষ্টের ছিল, আনিস কামাল লাঠি-বেত ছাড়াই দরজা বন্ধ করে ক্লাস নিত। কামাল যখন ক্লাস নিত, শিক্ষার্থীরা নিস্তব্ধ নীরবতার সঙ্গে মনোযোগী হয়ে ক্লাস করত। বর্তমান সময়ে যখন শিক্ষকরা প্রাইভেট আর কোচিং বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত, তখন আনিস কামাল কোচিং-বাণিজ্যের বিরোধী ছিলেন। তিনি এসবকে ঘৃণা করতেন।‘
‘কামাল সব সময় রিকশাচালককে ন্যায্য ভাড়ার থেকে দ্বিগুণ ভাড়া দিতেন। কোনো কাজ করালে শ্রমিককে বেশি পারিশ্রমিক দিতেন। বর্তমান সময়ে আনিস কামালের মতো শিক্ষক খুবই বিরল। তিনি সত্যিই একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন, সেইসঙ্গে আলোকিত মানুষ ছিলন। তাঁকে বর্তমান প্রজন্ম অনুসরণ করলে তারাও আলোকিত মানুষ হবে।’ বলছিলেন সহকারী শিক্ষক এ কে এম আজাদ।
মোহাম্মদ আনিসুর রহমান কামাল ১৯৭৫ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয় ছিলেন। তাঁর বাবা সাবেক জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মো. মকবুল হোসেন, মা জোবেদা মকবুল। আনিস কামাল ২০১৬ সাল থেকে কিডনিজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। টানা চার বছর চিকিৎসায় থাকাকালীন গত ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৪৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। আনিস কামাল সুনামগঞ্জ শহরের স্বনামধন্য কিন্ডারগার্টেন সৃজন বিদ্যাপীঠের পরিচালক ছিলেন। তিনি স্ত্রী শেখ ফারজানা ইসলাম সুমা ও সিরাজুস সালেকীন সাদাত সাত বছরের ছেলে রেখে গেছেন।
পূর্বপশ্চিমবিডি/ এনএন
Post Written by :
Original Post URL : https://ppbd.news/whole-country/173026/শিক্ষক-আনিস-কামালের-জন্য-কাঁদছে-সুনমাগঞ্জ
Post Come trough : PURBOPOSHCIMBD