ধেয়ে আসছে বিশ্বব্যাপী ভয়ঙ্কর মনস্তাত্বিক বিপর্যয়
অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরীপেন্ডেমিক বিশ্বে কালের পেন্ডুলামের টিক টিক ধ্বনি শত বিপত্তির মুখেও নিত্য সম্মুখে অগ্রসরমান। থেমে নেই মুখর জীবনের আহ্বান। বিপর্যস্ত-বিপন্ন মানব সম্প্রদায় করোনাকালের মৃত্যুভয়কে সঙ্গে নিয়েই মনোজাগতিক জটিল পরিবর্তিত পরিস্থিতির মাঝেই ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে। রুগ্ণ ব্যাধিগ্রস্ত পৃথিবী ইতিমধ্যেই সাত লক্ষাধিক মানুষের করুণ মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছে। সর্বত্রই নির্বাক মূঢ়তা, বিষণ্নতা, ঝড়-জল -বন্যার ভয়াবহতা গৃহবন্দী মানুষকে করেছে আরো অস্থির-অসহিষ্ণু। সমাজবদ্ধ জীবনে মানুষ অভ্যস্ত হলেও একাকীত্ব-নির্জনতাকে মানুষ গভীরভাবে উপভোগ করে। মগ্ন চৈতন্যের নিবিড়তায় হারিয়ে যেতে যেতে আপন সত্তাকে জাগ্রত করার প্রয়াস পায়। তবে সেটিও নেহায়েতই বৃত্তবন্দী ছক থেকে বেরিয়ে ক্ষণিকের অবসরযাপনে এমন আনন্দ তাঁকে প্রশান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দেয়। কিন্ত অনিশ্চিত জীবনে অভিশপ্ত করোনার অপরিণামদর্শী লকডাউনের সেই শুরু থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন আর ব্যস্ত ত্রস্ত জীবনে হঠাৎ ভাটা লেগে থমকে চমকে যাওয়া মানুষ আতঙ্কে-বিরক্তিতে-অস্বস্তিতে ডুবে শ্বাসরুদ্ধকর এমন পরিস্থিতিতে পরিত্রাণ শুধু নয় মানসিকভাবে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
মান-মনস্তত্ত্ব, বৈচিত্র্যে ভরা মনোজাগতিক জীবনের রহস্যজাল বড়ো দুর্ভেদ্য । কিশোরী বেলায় বিটিভিতে Mysterious Island নামে একটা ইংরেজী সিরিয়াল খুব আগ্রহভরে পরিবারের সাথে দেখতাম; তখন বুঝিনি জটিল জীবনের পরতে পরতে শুধু রহস্যই নয়; ভাঙ্গা-গড়া, বিষাদ-অবসাদ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, অহিসং-সহিংসতার মোড়কে মুখ আর মুখোশের বিচিত্র প্রতিচ্ছবি। রিয়েল-আনরিয়েলের অকাট্যতার নগ্ন উন্মাদনা। সুদৃশ্য পরিপাটি মুখাবয়বের পেছনে লোলুপতার লকলকে রক্তাক্ত জিহ্বা। আজও কিছু মানুষের মধ্যে আদিমতার-নৃশংসতার সর্বগ্রাসী মনোবৃত্তি করোনাকালের মৃত্যুভয়কেও হার মানায়।
করোনা যেখানে চিরায়ত জীবনধারার ইতিবাচক দিকগুলোকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে প্রথাসিদ্ধ জীবনের বিরুদ্ধে সেখানে কতক মানুষরুপী অমানুষের দোর্দণ্ড তাণ্ডবে বিষাদগ্রস্ত গৃহবন্দী জীবনেও নেমে এসেছে নারী-শিশুর ওপর নিপীড়ন নির্যাতনের খড়গ। অধ্যাপক আহমদ শরীফের নারী ভাবনার মতো করে বলতে হয়, নারী নির্যাতনের ও মানসিকভাবে নারী নিপীড়নের মূলে রয়েছে সুপ্রাচীনকাল থেকে পুরুষ প্রধান সমাজের নানা নীতি নিয়ম, রীতি রেওয়াজ এবং দেশকালগত নানা বিশ্বাস সংস্কারের মধ্যে সম্ভোগ্য-সম্ভোক্তা সম্পর্কটাই মুখ্য। (দর্শন ও প্রগতি , বর্ষ ২৯ , ১ম ও ২য় সংখ্যা পৃ: ৮৫)। উদ্ধৃতির বিশ্লেষণের গভীরে প্রবেশ না করেও দেখা যাচ্ছে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বেড়েই চলেছে আশঙ্কাজনক হারে। গত মে (২০২০) মাসে এই হার অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় ৩১ শতাংশ বেশি। পারিবারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, নিপীড়ন-নিগ্রহ, কলহ-বিবাদ তথা শারীরিক- মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা। বিপরীত চিত্র যে নেই সেটি কিন্ত এ সময় আর হলফ করে বলা যাবে না। সেজন্যই home sweet home ই বলি আর আমার ঘর আমার বেহেশতই বলি না কেন কার্যতঃ সকলের ক্ষেত্রে বিষয়টা তেমন নয়। দীর্ঘ গৃহবন্দীত্বের সময়টাতে একসাথে, এক ছাদের নীচে স্বামী-স্ত্রী অবস্থানকালে যাপিতজীবনের নানান প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণার পাশাপাশি গৃহকর্মের অনিবার্য-অবধারিত কাজকর্ম দাম্পত্য সম্পর্কের মাঝে এক ধরণের মনস্তাত্বিক তিক্ততার সৃষ্টি করেছে। মানুষ আর যা-ই হোক একঘেয়েমি জীবনব্যবস্থায় বেশিদিন অভ্যস্ত থাকতে পারে না। দাম্পত্য সম্পর্কের বাইরেও থাকে ভিন্ন প্রেক্ষাপট বিপরীতের নানান অনুষঙ্গ। বলেছি তো মানব মনস্তত্ত্ব বড়ো জটিল। মানুষ তার নিজস্ব অবস্থানকে ছাপিয়ে বহু সত্তায়, বহু মাত্রায় আত্মিকভাবে অবস্থান করে। একইসাথে কল্পনার জগতে নিজেকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে উপল ভাঙ্গা চঞ্চলতায় অবগাহন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। সেক্ষেত্রে দাম্পত্য সম্পর্কে পাশের মানুষটি যদি পরষ্পরকে না বোঝেন তাঁর কাজের মর্যাদা-মূল্যায়ন না করেন তাহলে সে ঘর-সংসার হয়ে ওঠে দুর্বিষহ এক কারাগার। আপন ধ্যানের পরশ পাথরে "ভালোবাসা'' শব্দটি তাদের জীবন থেকে বিলুন্ঠিত হতে থাকে। ভঙ্গুর মনের বিষন্নতার অনিবার্য পরিণতি ভোগ করতে হয় নিরপরাধ অবুঝ শিশুদেরকে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে দাম্পত্য দূরত্ব-ব্যবধান, ফলশ্রুতিতে এসব তিক্ততা বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত গ্রহণকে তরান্বিত করে। জানা যায়, লকডাউনে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে অনলাইন পারিবারিক মামলা এবং বিবাহ বিচ্ছেদের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউজ লেটারের তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, বাংলাদেশে যৌন নিপীড়ন ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেড়েছে বহুগুণে। গত জুন মাসে (২০২০) দেশে ৭১০টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ছিলো ৬ শতাংশ। (প্রথম আলো, ২৫ জুলাই, ২০২০)। নিপীড়িত নারীদের ৯৭.৪ শতাংশই পারিবারিক সহিংসতা তো বটেই বেশি ঘটেছে স্বামীর হাতে। তাছাড়া, শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন, ছোটোখাট বিষয়কে কেন্দ্র করে শিশুদের ওপর অমানবিক-মধ্যযুগীয় কায়দায় শাস্তি প্রদান, হাসপতালে শিশু চুরি, নবজাতককে রাস্তায়-ডাস্টবিনে ফেলে যাওয়ার মতো হৃদয়হীন ঘটনা তো বেশুমার ঘটে চলেছে। শুধু স্বামী সংসারে নারী নির্যাতিতা নয়, নারীরা বিশেষতঃ কিশোরী থেকে প্রাপ্ত-অপ্রাপ্ত বয়স্ক তো রয়েছেই ধর্ষিতার তালিকায় রয়েছেন প্রতিবন্ধী নারীরাও। স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের পর্যবেক্ষণে নারী ও শিশু নির্যাতনের কারণ হিসেবে উঠে আসে- মানুষের ঘরে আটকে পড়া, কাজ না থাকা, আয় কমে যাওয়া, খাবারের সংকট, ঋণের চাপ এবং কোথাও কোথাও মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব নির্যাতন বেড়েছে। ঝুঁকি বেড়েছে নারীদের সামাজিক ক্ষেত্রেও। যাহোক, এসব চিত্র একটি দেশের একটি রাষ্ট্রের মানবিক মূল্যবোধের দৈন্যতাকেই উন্মুক্ত করে, মনস্তাত্বিক মনোবৃত্তির পক্ষাঘাতগ্রস্ততাকেই প্রকাশিত করে। সুশিক্ষার আকালকে বড়ো বেশি স্পষ্ট করে তোলে। মানুষ মনুষ্যবৃত্তির আড়ালে পশুবৃত্তিটাকে লালন পালন করে যাপিতজীবনে অশুভ দিকগুলোকে প্রকার-প্রকরণে বহুমাত্রিকতায় বৈধতা প্রদান করে চলেছে।
একে তো করোনাকাল ! তারওপর সামাজিক সুরক্ষার আকাল। কথিত দুবৃত্তদের দুবৃত্তায়নকে বিনাশ সাধনে সরকার নানামুখী সতর্কবার্তা ও শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করে চলেছেন। শুধু তাই নয় ত্রাণ, সেবা-পরিষেবা, আর্থিক অনুদান-প্রণোদনাসহ সুরক্ষার সব রকম সহযোগিতা সরকার দিয়ে যাচ্ছেন করোনা অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্তদের তো বটেই বন্যায় বানভাসি অসহায়দের মাঝেও। করোনাকালে উজানের ক্রমাগত ঢলে বন্যায় প্লাবিত জনপদ যেনো মড়ার ওপর খাড়ার ঘা।
নিস্তরঙ্গ-বিষাদগ্রস্ত পৃথিবীতে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এই মহামারীর প্রভাব যেনো শুষ্ক বনভূমিতে দাবদাহের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা কোভিড-১৯ এর কারণে সৃষ্ট মানসিক সমস্যাকে সুনামির সঙ্গে তুলনা করেছেন। বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহিত কামালের মতে, মানসিক রোগের মহামারী শুরু হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে করোনা ভাইরাসের চলমান ক্রমাগত আতঙ্ক, পরিচিত বৃত্তের বাইরে জীবনকে অভ্যস্ত করা, রোগাক্রান্ত হওয়ার হুমকি, আইসোলেশনের একাকীত্ব, চাকরী হারানোর ভয়, প্রিয় মানুষটিকে কাছে না পাবার হতাশা, নতুন করে মাত্রা পেয়েছে দাবিকৃত নতুন আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা, অনিশ্চয়তা উল্লেখযোগ্য।
করোনাকাল স্পর্শের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকেও করে তুলেছে প্রশ্নবিদ্ধ। এমন ভয়ঙ্কর সংকটকালে আপনজনদের একটু স্পর্শই মানুষকে দিতে পারতো শক্তি ও স্বস্তি। মনোবিদ স্টিভ কোলের মতে, যৌথতার সবচেয়ে শক্তিশালী নিরাপত্তা সংকেত হচ্ছে স্পর্শ। এই শারীরিক স্পর্শ ও স্নেহময় স্পর্শকে আপনি বিবেচনা করতে পারেন মৌলিক নিদর্শন হিসেবে যা বলবে কেউ একজন আছে যে আপনাকে নিয়ে চিন্তিত (বণিক বার্তা, ৩০ মে)। হারিয়ে যেতে চলেছে স্পর্শ অনুভবের সেই নির্ভরতার নিরাপদ আশ্রয়গুলো। যেখানে স্পর্শই একমাত্র ভাষা কোনটা ভালোবাসার আর কোনাটা ঘৃণা বা প্রত্যাখানের। কোভিড মানব মনোজগতে জলোচ্ছ্বাসের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণন বৃত্ত তৈরি করে চলেছে।
ডা: মোহিত কামাল আরো বলেন, এরই মধ্যে মেন্টাল এপিডেমিক শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্ত করোনায় বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহার এতো বেশি যে বিষয়টি "আন্ডারমাইন" হচ্ছে। যখন মৃত্যুহার কমে যাবে তখন মানসিক দুরবস্থার বিষয়টিও দৃশ্যমান হবে।
সায়েন্টিফিক আমেরিকার মতে, ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো মনস্তাত্বিক পরীক্ষায় পৃথিবী। জীবিত মানুষ মৃতের মিছিলে শরীক হয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্নটিকে জিইয়ে রেখে চলেছে বড়ো দুরু দুরুদুরু বক্ষে; যেনো মৃতের জন্য রোদন নয়, আজরাইলের ঘর চেনার জন্য ক্রন্দন।
মনো বিশ্লেষকরা বলেন, মানসিক চাপ মানুষের মধ্যে এক ধরণের আবেগের সৃষ্টি করে যা তাকে অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় পতিত করে; ফলে রাগ, ক্ষোভ, বিরক্তি, অবসাদগ্রস্ততা, ভুলে যাওয়ার প্রবণতা, সিদ্ধান্তহীনতায় অসহায় মানুষ ভুগতে থাকে। এমন পরিস্থিতিকে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানে 'সাইকোলজিক্যাল ডিজরাপশন' বলা হয়ে থাকে।
সূত্রমতে, চীনের উহান নগরী যেখান থেকে মারণী করোনা প্রথম উদ্ভূত হয়েছিলো। এক জরিপ বলছে, সেখানকার ৩৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী মানসিক সমস্যায় ভুগছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ন্যান্সি সিনের মতে, যতোই দিন যাচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা প্রতিনিয়ত অবনতির দিকেই যাচ্ছে। অবস্থা যেদিকেই মোড় নিক না কেনো, মৃত্যু-স্মারক চিহ্নিত এই জীবনে দেশ কাল, জাতি, ধর্ম, বর্ণ-লৈঙ্গিক পার্থক্য ঘুচিয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোকে হতে হবে আরো সাহসী আরো সংবেদনশীল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বার্তা অনুযায়ী, মানসিক সমস্যা ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংকট হয়ে উঠবে। তদুপরিও করোনাক্রান্ত পৃথিবীর বিমূঢ়তাকে সমস্ত প্রাণশক্তি নিয়ে মোকাবিলা করার মানসে পুরো বিশ্বের সদিচ্ছা ও শুভশক্তিকে প্রয়োগ করে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৃহত্তর মানবকল্যাণের স্বার্থে সমন্বিত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণই পারে এ মহাবিপর্যয়কে রুখে দিতে; জীবনকে জাগাতে।
লেখক: অধ্যাপক দর্শন বিভাগ ও শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, সরকারি তিতুমীর কলেজ।
পূর্বপশ্চিমবিডি/জেডআই
Post Written by :
Original Post URL : https://ift.tt/30xoabz
Post Come trough : PURBOPOSHCIMBD