অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সদা সোচ্চার
ড. আতিউর রহমানরংপুরের রানীপুকুরে বিশাল এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালের ৬ এপ্রিল। শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য নেতারা এদিন মুসলিম লীগ শাসনব্যবস্থার কড়া সমালোচনা করেন। শেখ মুজিবুর রহমান তার বক্তব্যে বলেন, ‘অগণিত মুসলমান নারী-পুরুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাকিস্তান অর্জিত হয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল আমরা মুসলমান যেন শান্তিতে বসবাস করতে পারি। কিন্তু কোথায় সেই শান্তি? দেশভাগের পর খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন, আর তার পর তাৎক্ষণিকভাবে তিনি আর্থিক ক্ষতির কারণ দেখিয়ে এজি হাসপাতাল উঠিয়ে দিলেন। এর বিনিময়ে চালু করলেন কর্ডন প্রথা।‘ (‘গোয়েন্দা প্রতিবেদন’, ভলিউম-৩, পৃষ্ঠা-১৫৬)
কর্ডন প্রথার সমালোচনা করে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, এটা ভূমিহীন কৃষকদের জন্য একটা পাতানো বোমা। উল্লেখ্য, এই প্রথার কারণে ‘দাওয়াল’ তথা দক্ষিণাঞ্চল থেকে যাওয়া কৃষিশ্রমিকদের ভাগের ধান পেতে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল তার বিরুদ্ধে তিনি জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। অন্যদিকে ১৯৪৮ সালে জনগণ যখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে আন্দোলন শুরু করলেন তখন তাদের ধরে ধরে জেলে ভরা হলো। পাটের বাজার হারানোর প্রসঙ্গ ধরে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, অদক্ষ নীতিমালার কারণে বর্তমান সরকার অর্থনৈতিক সংকট হাত ধরে টেনে এনেছে। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৫৬)
শেখ মুজিবুর রহমান তার বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করে বলেন, ‘বর্তমান সরকার শুধু ধনীদের সন্তানদের জন্যই শিক্ষা চায়। ঢাকায় ২৩ লাখ রুপিতে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাই তার প্রমাণ। অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বছরে লাখ লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে, কিন্তু অন্যদিকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি সাহায্যের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। সরকারের এই বিমাতাসুলভ আচরণই প্রমাণ করে যে, আপামর জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে তারা অপারগ।’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৫৭)
শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য জনমনে কীরকম প্রভাব ফেলেছে সেই তথ্যও গোয়েন্দারা নথিভুক্ত করেন। ‘উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার বেশিরভাগই ছিলেন গ্রামের অশিক্ষিত লোকজন। বক্তারা যখন একতরফাভাবে বর্তমান মুসলিম লীগ সরকারের সমালোচনা করেন শ্রোতারা তা বিশ্বাস করতে বাধ্য হন। তারা বিশ্বাস করেন যে, মুসলিম লীগ আসলেই তাদের জন্য ভালো কিছু করেনি। অনেকে অবশ্য এরকমও বলেছে যে, এসব প্রোপাগান্ডা ছাড়া কিছু নয়।’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৫৮)
৭ এপ্রিল রংপুরের হারাগাছায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান আগের দিনের অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ব্রিটিশ শাসন আর মুসলিম লীগ শাসনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তিনি বলেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন মুসলিম লীগের একজন প্রথম সারির নেতা। পাকিস্তান আনার পেছনে তার বিরাট ভূমিকা আছে। সেই সোহরাওয়ার্দীকে দূরে ছুড়ে ফেলে মুসলিম লীগ খাজা নাজিমুদ্দীনকে কাছে টেনে নিয়েছে। দেশভাগের পর তিনি পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। অথচ পাকিস্তান সৃষ্টির সময় তিনি ব্রিটিশ প্রতিনিধি হয়ে ওয়াশিংটন ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। পূর্ববাংলার জনগণের সঙ্গে তো তার কোনো সম্পর্কই নেই।
রংপুরের তামাকের সমৃদ্ধ বাজারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই রংপুর জেলা, বিশেষ করে হারাগাছা তামাকের জন্য বিখ্যাত। বার্মা, সুমাত্রা, মাদ্রাজ থেকে বণিকরা আসতেন এখানে তামাক কিনতে। মুসলিম লীগের ভ্রান্ত নীতির কারণে সেই বাজার আমরা হারিয়েছি। অন্যদিকে নোয়াখালী-খুলনা থেকে হারিয়েছি সুপারির ব্যবসা। আগে পূর্ববাংলা থেকে ইন্ডিয়া-করাচি সুপারি রপ্তানি হতো। এখন করাচির লোকজন পূর্ববাংলা থেকে সুপারি কিনতে চায় না। তারা সুপারি কিনে সিলন থেকে। সুপারি বিক্রির আয়ের চেয়ে এখন ট্যাক্স বেশি। পূর্ববাংলার মানুষ লবণ উৎপাদন করতে পারত। পূর্ববাংলায় লবণশিল্প গড়ে উঠুক সরকার তা চায়নি। বরং করাচি থেকে বেশি দামে লবণ কিনতে বাধ্য করেছে। কিন্তু এর বিনিময়ে পূর্ববাংলা থেকে তারা সুপারি কেনেনি। এটা পূর্ববাংলার অর্থনীতির মেরুদ- ভেঙে দেওয়ার পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সরকারের পাটনীতির সমালোচনা করে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, সরকার পাটের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু পাট বোর্ডের কেউ সরকারের নির্ধারিত মূল্যে পাট ক্রয় করেনি। তারা সরকারের নীতি ভঙ্গ করেছে, কিন্তু কেউ তাদের কিছু বলেনি। অন্যদিকে রপ্তানিকারকদের কেন মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। ফলে রপ্তানিকারকরা কম মূল্যে পাট ক্রয় করে অধিক মূল্যে, কখনো শতরুপি লাভে পাট বিক্রি করেছে। এই রপ্তানিকারকরা হলেন জুট বোর্ডের এজেন্ট এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক। তারা প্রচুর লাভবান হয়েছেন, কিন্তু আমরা বিদেশি বাজার হারিয়েছি।
পাকিস্তানের ন্যাশনাল ব্যাংক গড়ে উঠেছে জনগণের টাকায়। জুট বোর্ডের এজেন্টদের এই ব্যাংক থেকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছ পাটের ব্যবসা করার জন্য। এই এজেন্টরা পাট উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ কম মূল্যে পাট ক্রয় করেছে, অন্যদিকে যতটা পেরেছে অধিক দামে বিদেশিদের কাছে পাট বিক্রি করেছে। এই কারণে পাটের ব্যবসা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।” (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৬৩-১৬৪)। ওপরের এই ‘গোয়েন্দা প্রতিবেদন’ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, কত আগে থেকে পাকিস্তানের দুই অর্থনীতির অস্তিত্ব অনুভব করতেন তিনি। তখনো পূর্ববাংলার অর্থনীতিবিদরা ‘দুই অর্থনীতি’ বিষয়ে মুখ খোলেননি। কিন্তু তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পূর্ববাংলার অর্থনৈতিক শোষণের খোঁজ রাখতেন এবং সাধারণের বোধিগ্য ভাষায় তা প্রকাশ করতেন। পনেরোশ মাইল দূরে অবস্থিত পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের অর্থনীতি যে এক হতে পারে না তার এই ধারণা আরও পোক্ত হয় যখন ১৯৫৪ ও ১৯৫৬ সালে দুবার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী হন। খুব কাছ থেকে তিনি দেখতে পান এই তীব্র শোষণব্যবস্থা আর এই অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি প্রণয়ন করেন বাঙালির বাঁচার দাবি ‘ছয় দফা’।
৮ এপ্রিল রংপুরের মিঠাপুকুরে বক্তব্য দিতে গিয়েও শেখ মুজিবুর রহমান উপরোল্লেখিত বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন। এদিন সভায় নিম্নোক্ত দাবি-দাওয়াগুলো নির্ধারিত হয় :
১. মওলানা ভাসানীসহ অন্য বন্দিদের অতি শিগগির মুক্তি দাবি।
২. রাষ্ট্রভাষার বাংলা দাবি।
৩. বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথা বিলোপ দাবি।
৪. পাটের ন্যূনতম মূল্য ৩০ রুপি নির্ধারণ দাবি।
৫. যোগাযোগ সমস্যা দূরীকরণে স্থানীয় পোস্ট অফিসে টেলিগ্রাফ অফিস স্থাপনের দাবি।
৬. স্থানীয় শালবনে গরু চরানো নিষেধ নোটিশবোর্ড সরানোর অনুরোধ।
৭. বস্ত্র, তামাক, সুপারির ওপর ট্যাক্স কমিয়ে গরিবদের সাহায্য করার দাবি।
৮. ভেন্ডাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি সাহায্য বরাদ্দের দাবি।
(প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৬৮)
আটক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিবৃতি দেন, যা দৈনিক আজাদে প্রকাশিত হয় ১৪ এপ্রিল। পূর্ণাঙ্গ বিবৃতিটি নিচে দেওয়া হলো :
আটক বন্দীদের মুক্তি দাবী
শেখ মুজিবর রহমানের বিবৃতি
পূর্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী জনাব শেখ মুজিবর রহমান সংবাদপত্রে নিম্নোলিখিত বিবৃতি দিয়েছেন :
“সম্প্রতি চাঁদপুর, যশোর ও রংপুর সফরে গমনের পূর্ব্বে আমি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দান সম্পর্কে জনাব নুরুল আমীনের সহিত সাক্ষাৎ করি। অন্যান্য কতিপয় নেতাও আমার সঙ্গে ছিলেন। জনাব নুরুল আমিন আমাদিগকে বলেন যে, সরকার রাজনৈতিক বন্দীদের ক্রমে ক্রমে মুক্তি দানের নীতি অবলম্বন করিয়াছেন। আমরা তাঁহাকে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিদান ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনীয়তা বুঝাইয়া দেই এবং তিনি আমাদিগকে এই আশ্বাস দেন যে, বিষয়টা পূর্ব্বাপেক্ষা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হইবে। কিন্তু প্রায় তিন সপ্তাহ পূর্ব্বে জনাব নুরুল আমীনের সহিত আমাদের সাক্ষাৎকারের পর এযাবত আর কাহাকেও মুক্তি দেওয়া হয় নাই দেখিয়া আমরা আশ্চর্য্য হইতেছি। গত মাস খানেক যাবত রোজা রাখা ও শুধু পানি দিয়া এফতার করার দরুন জেলে মওলানা ভাসানী ও অন্যান্যের স্বাস্থ্যের অবস্থার অত্যন্ত অবনতি হইয়াছে।
সরকার দীর্ঘদিন যাবত আটক রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেন নাই। তদুপরি তাঁহারা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নেতাদের গ্রেফতার অভিযান নূতন করিয়া শুরু করিয়াছেন। উদারহণস্বরূপ চাঁদপুর, বরিশাল ও কুষ্টিয়ার বিষয় উল্লেখ করা যাইতে পারে। বিরোধীদলকে দমাইয়া রাখিবার জন্য সরকার সর্ব্বশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজকেও কাজে লাগাইয়াছেন। সভা সমিতি, বিক্ষোভ ও ধর্ম্মঘট প্রভৃতিতে যোগদানের জন্য সরকার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলিকে ছাত্রদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বনে বাধ্য করিয়াছেন।
সরকার সম্প্রতি সকল বিভাগে ছাঁটাই নীতি অবলম্বনেও সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। ইহার ফলে যাহারা বেকার হইয়া পড়িবে, বর্ত্তমান আর্থিক সঙ্কটের দিনে তাহাদের দুর্দ্দশার সীমা থাকিবে না। সরকারের এই সব কার্য্যকলাপ দেশের সর্ব্বত্র অসন্তোষের সৃষ্টি করিবে।
আমি সরকারের নিকট অবিলম্বে বিনা বিচারে আটক সকল রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি দাবী করিতেছি।
আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ১৭ই এপ্রিল তারিখে প্রদেশের সর্ব্বত্র বন্দী মুক্তি ও প্রার্থনা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। এই দিবসকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য আমি সকল ইউনিটের প্রতি আবেদন জানাইতেছি।”(প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৭৭)। শেখ মুজিবুর রহমানের এই হৃদয়গ্রাহী রাজনৈতিক বিবৃতি থেকেই বোঝা যায় কী গভীর নিষ্ঠার সাথে পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষের দুঃখ ও বঞ্চনাকে অনুভব করতেন। দলের নেতাদের মুক্তির জন্যও তিনি সদা সোচ্চার। এই গভীর অনুভব থেকেই তিনি ধীরে ধীরে বাঙালির মুক্তির মুখপাত্র হিসেবে বের হয়ে আসেন। (চলবে)
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
সূত্র: দৈনিক আমাদের সময়
পূর্বপশ্চিমবিডি/এসএস
Post Written by :
Original Post URL : https://ift.tt/2DMNQZ8
Post Come trough : PURBOPOSHCIMBD