মেজর সিনহার মাকে সেনাপ্রধানের চিঠি
নিজস্ব প্রতিবেদককক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের মা নাসিমা আক্তারকে চিঠি দিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। বৃহস্পতিবার (৬ আগস্ট) দেয়া চিঠিতে তিনি সিনহার পরিবার প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করে বলেন, মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের (অব.) অকাল মৃত্যুতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সকল সদস্যদের পক্ষ হতে আমি গভীর শোক ও আন্তরিক সমবেদনা প্রকাশ করছি।
মেজর সিনহার অকাল প্রয়াণে সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত শােকাহত এবং ব্যথিত। সন্তানহারা মাকে সান্ত্বনা প্রদানের উপযুক্ত ভাষা বােধকরি খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তবুও, এই চরম শােকাবহ মুহূর্তে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার নিকট প্রার্থনা করি যেন তিনি আপনার ও আপনার পরিবারের সকল সদস্যদেরকে এই শোক কাটিয়ে উঠার শক্তি প্রদান করেন।
মেজর সিনহা একজন প্রতিশ্রুতিশীল, দক্ষ, সৎ, সাহসী এবং কর্তব্যপরায়ণ অফিসার ছিলেন। চাকরি জীবনে সকলের সাথে সুহৃদ আচরণ ও সহযােগিতামূলক মনােভাবের কারণে সকল স্তরের সেনাসদস্যের কাছে তার গ্রহণযােগ্যতা ছিল প্রশংসনীয়।
২০১৮ সালে তিনি স্বেচ্ছায় চাকরী হতে অবসর গ্রহণ করলেও তিনি সেনাপরিবারের একজন গর্বিত সদস্য ছিলেন। একটি অনাকাঙ্কিত ঘটনায় এমন একজন তরুণ তাজা প্রাণ এর মর্মান্তিক মৃত্যুতে সেনাবাহিনী তথা দেশ একজন অমিত সম্ভাবনামী সন্তানকে হারিয়েছে। এই অপূরণীয় ক্ষতি লাঘবের সাধ্য কারও নেই। আমরা সকলে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার কাছে মেজর সিনহা এর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে আমি আপনাকে আশ্রয় করতে চাই যে, অবসরপ্রাপ্ত হলেও, মেজর সিনহা এর মর্মান্তিক মৃত্যুর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইতোমধ্যেই আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এবং সহানুভূতির সাথে সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
এরই ফলশ্রুতিতে একটি উচ্চ পর্যায়ের যৌথ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং উক্ত কমিটি সরেজমিনে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য অনুসন্ধান ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার লক্ষ্যে কাজ করছে। এছাড়াও, এই অনাকাঙ্কিত মৃত্যুর সঠিক কারণ অনুসন্ধান ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর পক্ষ হতে প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিবিড় যােগাযােগ হাপন করা হয়েছে।
আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই যে, আপনার সন্তানকে আমরা ফিরিয়ে দিতে পারবনা, তবে তার এই অকাল মৃত্যুর সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে ইনশাআল্লাহ।
সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা আপনার প্রয়াত সন্তানকে জান্নাতবাসী করুন এবং আপনাকে ও আপনার পরিবারের সকলকে শােক সহ্য করার ধৈর্য ও মনােবল দান করুন এই প্রার্থনাই করছি।
প্রসঙ্গত, দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া সিনহা মো. রাশেদ খান ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গত প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। আরো তিন সঙ্গীকে নিয়ে তিনি উঠেছিলেন নীলিমা রিসোর্টে। গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন।
ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারের কথা জানিয়ে সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে। এই ঘটনায় পুলিশ মামলাও করে। তবে পুলিশের এই ভাষ্য নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনের প্রতিনিধি নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এদিকে সিনহাকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে বুধবার কক্সবাজারের আদালতে মোট ৯ পুলিশকে আসামি করে মামলা করেন তার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। আদালতের নির্দেশে বুধবার রাতেই মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত হয়। এই হত্যা মামলায় বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে ১ নম্বর এবং টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে। অন্য আসামিরা হলেন- এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এএসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফা।
মামলার পর ওইদিন বিকালে টেকনাফ থানা থেকে ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে প্রত্যাহার করা হয়। পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ২০ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে পাঠানো হয় দুদিন আগেই। এ মামলায় বৃহস্পতিবার টেকনাফ থানা থেকে প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, শামলাপুর তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতসহ ৭ আসামির প্রত্যেককে র্যাব হেফাজতে সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। একই সঙ্গে পলাতক ২ আসামি এএসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফাকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
এজাহারে সিনহার বোন অভিযোগ করেন, ওসি প্রদীপের ফোনে পাওয়া নির্দেশে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এসআই লিয়াকত আলী গুলি করেছিলেন সিনহাকে। এ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় ‘ইচ্ছাকৃত নরহত্যা’, ২০১ ধারায় আলামত নষ্ট ও মিথ্যা সাক্ষ্য তৈরি এবং ৩৪ ধারায় পরস্পর ‘সাধারণ অভিপ্রায়ে’ অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০২ ধারার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ঘটনার সময় সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে (২১) মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে। ঘটনার দিনই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, মাদক ও অস্ত্র আইনের মামলায় তাকেও আসামি করা হয়।
সিনহা নিহতের ঘটনায় জড়িত সব পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে বুধবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের সমিতি রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া)। একই দিন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ কক্সবাজারে গিয়ে সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, এই ঘটনায় যে এই ঘটনায় দায়ী হিসেবে যে বা যারা চিহ্নিত হবে, তারাই শাস্তি পাবে। এর দায় বাহিনীর উপর পড়বে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মঙ্গলবার সিনহার মা নাসিমা আখতারকে ফোন করে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দেন।
পূর্বপশ্চিমবিডি/এসএস
Post Written by :
Original Post URL : https://ift.tt/3a2CI6h
Post Come trough : PURBOPOSHCIMBD