ড. মাহবুব উল্লাহ্ তথ্য বিকৃত করেছেন
খোলামত
আবুল কালাম আজাদআন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া সুধাসদনে যান। তার সঙ্গে মওদুদ আহমদসহ অন্য নেতারা ছিলেন।
কিছুক্ষণ নিচে বসার পর বেগম জিয়া দোতলায় যান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য। তারা বেশকিছু সময় আলাপ-আলোচনা করেন। ঘটনাটি ২০০৯ সালের মে মাসের।
ডা. জাফরুল্লাহর একটি খোলা চিঠিকে কেন্দ্র করে ড. মাহবুব উল্লাহ্ ‘প্রধানমন্ত্রী আমলে নেবেন কিনা জানি না’ শীর্ষক লেখাটি ৩০ জুলাই যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছে।
মাহবুব উল্লাহ্ লিখেছেন ‘শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় তখন শেখ হাসিনা তার সঙ্গে দেখা করেননি।’
ড. মাহবুব উল্লাহ্ সুকৌশলে বলেছেন উপরের কথাগুলো। নিজের বক্তব্য বিএনপির নেতাকর্মীদের কাঁধে চাপিয়ে দিলেন। তিনি তার লেখায় বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আর শেখ হাসিনা বলে সম্বোধন করেছেন। তার নামের আগে কিছু নেই। ওই সময় খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী নন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে খালেদা জিয়ার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি। অথচ মাহবুব উল্লাহ্ বলে দিলেন, দেখা হয়নি।
অনেকেই হয়তো তার এ কথাগুলোকে অসত্য বক্তব্য বলবেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ শব্দগুলো পছন্দ করি না। তার বেলায় প্রয়োগও করতে চাই না। তবে তিনি জেনেশুনেই এ তথ্য বিকৃত করেছেন। তিনি কোনো কিছু জানেন না বা ঘটনা সম্পর্কে অবহিত নন- এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তিনি এটি কেন করলেন?
২০০৯ সালের ঘটনা। তখন যেসব ছেলেমেয়ের বয়স ১০-১২, এখন তারা যুব সম্প্রদায়। তিনি এটি করেছেন এ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার জন্য। ইতিহাস বিকৃতি, প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা এদের মজ্জাগত। তিনি কী কারণে বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করলেন জানি না। উদ্দেশ্য ছাড়া তারা কথা বলেন না বা লেখেন না।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনা মনে পড়ল। মাহমুদুর রহমান মান্না ২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে অবস্থানরত বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকাকে (প্রয়াত) ফোন করেন। ফোনে তিনি শেখ হাসিনার সরকার পতনের লক্ষ্যে আন্দোলন চাঙা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪-৫টি লাশ ফেলে দেয়ার ব্যবস্থা করার জন্য বলেন।
ফোনালাপে বলেন, সরকারের পতন ঘটাতেই হবে। প্রয়োজনে সামরিক শাসন। আরও অনেক কথা আছে। দীর্ঘ ফোনালাপ। এটি গণমাধ্যমে চলে আসে। তখন এ নিয়ে টিভি টকশো হয়। পত্রপত্রিকায় নিউজ, আলোচনা তো ছিলই।
মাছরাঙা টিভির একটি টকশোতে আমি আমন্ত্রিত ছিলাম, আর ছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং ড. মাহবুব উল্লাহ্। সঞ্চালক ছিলেন মৌ।
আলোচনার এক পর্যায়ে মান্না সাহেবের ভিডিও প্রদর্শন করে মতামত চাওয়া হয়। ড. মাহবুব উল্লাহ্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তিনি স্পষ্ট করে কিছু বোঝেননি। তখন আমি বলেছিলাম- আমাদের দুর্ভাগ্য, একশ্রেণির পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী নিজেদের পছন্দের বাইরে গেলেই আর কিছু বোঝেন না। সঞ্চালক বুঝলেন, মকসুদ ভাই বুঝলেন, আমি বুঝলাম অথচ মাহবুব উল্লাহ্ মান্নার কথা বুঝলেন না।
মুশতাক খুনিচক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে যান তার সুযোগ্য দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের পরম আদরের ১০ বছরের শিশু রাসেলকেও রেহাই দেয়নি।
সেই কালরাতে শাহাদতবরণ করেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, শেখ জামাল, তাদের স্ত্রীদ্বয় সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরসহ আরও অনেকে। খুনিদের জিয়া-খালেদা লালনপালন করেছেন। বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দিয়েছেন। সংসদে আইন করেছেন বিচার না করার জন্য। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২১টি বছর ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রবাহিত করেছেন ভিন্ন খাতে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঈদের দিন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব দিয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ। বলেছেন, তাতে শেখ হাসিনার বিরাট রাজনৈতিক সুবিধা আদায় হবে। মাহবুব উল্লাহ্ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন, আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা বলবেন- আসামির সঙ্গে দেখা করবেন কেন? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক সুবিধা দিতে চান কে, জনাব জাফরুল্লাহ; যিনি শেখ হাসিনা এবং তার দলকে পরাজিত করার জন্য জামায়াত-বিএনপিকে নিয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা।
ডা. জাফরুল্লাহ টিভি টকশোতে বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরী অথবা নূরকে ক্ষমা করে দিতে বলেন। পরে জানা গেল, ওই খুনিরা তার দূরসম্পর্কের আত্মীয়।
ড. মাহবুব উল্লাহ্ ঠিকই বলেছেন। আসামির সঙ্গে কেন দেখা করতে যাবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা? আর এ আসামি সেই আসামি, যিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন সারা জীবন। বঙ্গবন্ধুর খুনি খায়রুজ্জামানকে (সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত) রাষ্ট্রদূত বানিয়েছেন। অপর খুনি সেনাবাহিনীর আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে মারা যাওয়ার পর পদোন্নতি দিয়ে সমুদয় পাওনা পরিবারকে দিয়েছেন।
খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সরকারের জ্ঞাতসারে হাওয়া ভবনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। আল্লাহর অশেষ রহমত ও জনগণের দোয়ায় সে যাত্রায় তার জীবন রক্ষা পায়। গ্রেনেড হামলার পরপরই প্রচার করা হয় শেখ হাসিনার হাতব্যাগ থেকে এ গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। পরে শুরু হয় জজ মিয়া নাটক।
দেশবাসীর এখনও মনে আছে সেসব ঘটনা। শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বিভিন্ন সময়ে কমপক্ষে ২১ বার চেষ্টা করা হয়। কারা এ হামলার অপচেষ্টা চালিয়েছে, এখন আর তা কারও অজানা নেই।
খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ মানবিক কারণে তাকে ৬ মাসের জন্য মুক্তি দেয়া হয়েছে। মাহবুব উল্লাহ্ তার লেখায় প্রশ্ন রেখেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মুক্তি দিতে পারেন কিনা? যদিও পরে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
কোকো মারা যাওয়ার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুলশানে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে গিয়েছিলেন, তাকে সহানুভূতি জানাতে। খালেদা জিয়া তখন কার্যালয়েই ছিলেন। গাড়ি ঢোকার বড় গেটটি সঙ্গে সঙ্গে তালা মেরে দেয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন গাড়িছাড়া হেঁটেই রওনা দিলেন তখন ছোট গেটও তালা মেরে দেয়া হয়।
খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী, থাকতেন সেনানিবাসে। অনেক সময় সিএমএইচে চিকিৎসাধীন সামরিক বাহিনীর সাবেক সদস্যদের দেখতে গেলে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার গাড়ি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ঢুকতে দেয়া হতো না। জাহাঙ্গীর গেট থেকে সিএমএইচ পর্যন্ত দীর্ঘ পথ তাকে হেঁটে যেতে হতো। এসব আচরণ দেশবাসী ভোলেনি।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদত দিবস ১৫ আগস্ট। এ দিবসটিতে যাতে শোক পালন করা না যায়, বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করা না যায়, সে জন্য ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন করা হয়। সদ্যপ্রয়াত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ এ ভুয়া জন্মদিনের আবিষ্কারক। তাকে সহায়তা করেছেন খালেদা জিয়ার এক সময়ের প্রেস সেক্রেটারি মরহুম মোজাম্মেল হক এবং অনেকে। আমার প্রশ্ন- খালেদা জিয়া তো থামিয়ে দিতে পারতেন তাদের এ অন্যায়-অমানবিক কাজ থেকে বিরত রাখতে; করেননি। আর আজ তার সঙ্গেই দেখা করতে যেতে হবে জাফরুল্লাহ সাহেবদের পরামর্শে!
তিনি আর একটি তত্ত্ব হাজির করেছেন, তা হল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। ব্যক্তি শেখ হাসিনার সমালোচনা করা যায়। আমার বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ব্যক্তি। তা সত্ত্বেও সরকার পরিচালনার কারণে ভুলভ্রান্তি হতেই পারে। সে কারণে প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করা যায়।
ব্যক্তি শেখ হাসিনা অত্যন্ত সম্মানিত, মমতাময়ী, ধর্মভীরু, মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তার মেধা, শ্রম, কর্তব্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, সততা ঈর্ষণীয়। তার দূরদৃষ্টি, প্রজ্ঞা, মানুষের জন্য মমত্ববোধ অতুলনীয়। তার প্রজ্ঞা ও মেধা দিয়ে ইতোমধ্যেই তিনি বিশ্ব পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন। বিশ্ব নেতাদের সমীহ আদায় করেছেন। বিশ্ব নেতারা তাকে মমতাময়ী মা উপাধি দিয়েছেন।
খোলা চিঠির লেখক ও ড. মাহবুব উল্লাহ্ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের ওপর নির্ভর করতে বারণ করেছেন।
একজন সাংবাদিক হিসেবে কেন যেন আমার মনে হয়, এ খোলা চিঠি ও মাহবুব উল্লাহ্র লেখা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তা না হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দূরে রাখতে কেন বলা হবে? যারা জীবন বাজি রেখে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের দমনের কাজে নিয়োজিত থাকে।
দুর্নীতিবাজদের এবং অন্য সমাজবিরোধীদের বিষয়ে তথ্য দিয়ে গোয়েন্দারা সরকারকে সাহায্য করে। আমলারা নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে। সাম্প্রতিক করোনা রোধে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্য, আমলা, গোয়েন্দারা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন। তাদের বহু সদস্যের প্রাণহানিও ঘটেছে।
তাহলে কী কারণে তাদের দূরে রাখতে বলেছেন! সরকারের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি করার উদ্দেশ্য কী- এ কথা ভেবে দেখা দরকার।
আবুল কালাম আজাদ : প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর
পূর্বপশ্চিমবিডি/এইচ
Post Written by :
Original Post URL : https://ift.tt/31hoXNe
Post Come trough : PURBOPOSHCIMBD