সালমা তানজিয়া:
বাদল শেষের সূর্যালোকিত বিকেল বেলার মত
উজ্জ্বল অবয়বে
বাংলাদেশের মানচিত্র দেখিয়ে
তার শিশু পুত্রকন্যাকে বাবা বলতেন
-এই যে দেখছিস ৫৬ হাজার বর্গমাইল,
এটাই তিনি।
কোনদিন উদাস চোখে বাড়ির পাশের
বিদ্যাপিঠে পতপত করে উড়তে থাকা
পতাকার দিকে আঙুল তুলে বলতেন
-গর্বিত এ লাল সবুজেই মিশে আছেন তিনি।
বড় হয়ে ওখানেই পাবি তাঁর প্রতিচ্ছবি।
ঘটা করে বাসার গ্রামোফোন রেকর্ডে
বজ্র কণ্ঠের আবৃত্তি শুনিয়ে বলতেন
-কবিতাটি মুখস্ত বললে গোটা ১ টাকা পাবি,
১ টাকার লোভে মুখস্ত বলতাম কবিতাটা।
কিছু শব্দ, অচেনা ঝড় তুলত রক্তস্রোতে,
বাবা বলতেন অটুট বিশ্বাসে জেনে রাখিস
-এই কণ্ঠস্বরই আমাদের স্বাধীনতা,
রক্তে তোলপাড় করা
এ অনুভবের নামই স্বাধীনতার চেতনা,
বাঙালী জাতির সবচেয়ে প্রিয়তম কবিতাও এটা।
লালন করিস পরম মমতায় এ কথামালা আমৃত্যু।
আমরা তার সন্তানেরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি
দেওয়ালের পরে টাঙানো সৌম্য দর্শন
একজন মানুষের ছবি দেখিয়ে বলতেন
-দ্যাখ মন দিয়ে, ভাল করে দ্যাখ
একই সাথে এ মুখে খুঁজে পাবি
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর জীবনানন্দকে।
এই বিশাল মানুষটিই আমাদের
মহান মুক্তিযুদ্ধের যাদুকর মহাকবি।
মনে রাখিস আমাদের মুক্তিযুদ্ধও তিনি।
তিনিই প্রিয় মাতৃভূমি, আমাদের বাংলাদেশ।
সৌম্য মানবের নাম বলতেন- শেখ মুজিব।
বিস্ময়ে বিস্ফারিত শিশু দু’চোখ ও মনের
অবুঝ অবিশ্বাসী দ্বিধান্বিত জিজ্ঞাসা ছিল-
মানুষ কখনও বুঝি পতাকা হয়,মানচিত্র হয়!?
যুদ্ধ হলে আবার কেমন করে কবি হয় তবে!?
পরম আদরে বুকে টেনে নিয়ে বলতেন
-বড় হলে তখন বুঝবি আমার কথার মানে।
ভুলে যাস না তাঁকে, সত্য বলে জানিস তাঁকে
ধারণ করিস তাকে বুকের গভীরতম প্রদেশে।
আমার শৈশব, কৈশোর বা তারুণ্যের শিক্ষালয়
আমাকে ভুলেও বলেনি তাঁর নাম,
শোনায়নি তাঁর অমর কবিতাখানি একবারও।
স্বাধীনতা মানে তিনি, পতাকায় তাঁর প্রতিচ্ছবি
বুকের গহীনে গেঁথে থাকা তোমার কথাগুলো
ভুলিয়ে দেবার শত সহস্র অপচেষ্টায় কতবার
বিপর্যস্ত হয়েছে কোমলমতি মন আমার বাবা।
তোমার ভালবাসায় লালিত পালিত আমার রক্তে
তবুও স্বাধীনতার চেতনা পাখা মেলেছে বাবা,
ডানা তার কাটতে পারেনি কোন অপশক্তি।
তোমার কাছ থেকে ১ টাকায় কেনা সেই কবিতা
আজ আমার চেতনার পবিত্র মহাকাব্য বাবা।
আমি তোমার আদর্শ নিয়ে বড় হয়েছি বলেই
অন্তর-বাইরে বুঝেছি বাবা তোমাকে এবং তাঁকেও।
জেনেছি তাঁর তর্জনীকে, ধারণ করেছি তাঁর স্বপ্নকে
তুমি আমার প্রেরণা বাবা, তিনি আমার সাহস
তিনি তোমার-আমার প্রেমময় অস্তিত্ব বাবা
তিনি আমার ভালবাসা, আমার বাংলাদেশ।
আমি তোমার পবিত্র রক্তের উত্তরাধিকার বাবা
আর তাঁর ঐতিহাসিক সাহসী তর্জনী ও স্বপ্নের।