নির্মাণে সৃজনে আবু সুফিয়ান বিপ্লব
বিনোদন
বিনোদন প্রতিবেদকঅনেকটা নিরবে নিভৃতে সময়কে ফ্রেমবন্দি করার চমক জাগানিয়া কিছু কাজ করে চলেছেন নির্মাতা আবু সুফিয়ান ভুইয়া বিপ্লব। চলতি বৈশ্বিক দূর্যোগকে যেভাবে সামাল দিচ্ছেন প্রান্তিক জনগণ, নানা অঞ্চল ঘুরেঘেটে তুলে আনছেন সেই চালচিত্র। তৃণমূল জনতার টিকে থাকার লড়াইয়ের এই সংগ্রামীকাহিনী ধারণে তাকে অর্থ-প্রণোদনা দিচ্ছে একাধিক উন্নয়ন সংস্থা। এরই অংশ হিসেবে করোনা ঝুঁকিতে স্বাস্থ্য বিধি মেনে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহটা শুটিং করে কাটালেন দেশের দক্ষিণপ্রান্ত উখিয়া-টেকনাফ-কক্সবাজারে ।
আবু সুফিয়ান বিপ্লব ফিকশন আর নন-ফিকশন, দুই ধারার নির্মাণেই হাত পাকিয়েছেন। পেশাগত জীবনে বিপ্লব গড়ে তুলেছেন নিজস্ব প্রডাকশন হাউজ ও নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গ্রিন ফ্রেম। প্রায় ১৫ বছর ধরে নিজ সংস্থার ব্যানারে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে কাজ করছেন। তার উল্লেখযোগ্য ক্লাইন্টের মধ্যে রয়েছে ইউএনডিপি, ইউএনএফপিএ, প্লান ইন্টারন্যাশনাল, ব্র্যাক, টিডিএইচ, একশনএইড, সেভ দ্য চিল্ড্রেন, ভিলেজ কোর্ট, এটুআই ইত্যাদি।
কেবল তথ্যচিত্র বা ডকুড্রামা নয়, ছোটপর্দায় প্রচারিত হয়েছে আবু সুফিয়ান বিপ্লব নির্মিত বেশ কিছু একক ও ধারাবাহিক নাটক। তার পরিচালনায় একপর্বের নাটক ও টেলিফিল্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- এ হামিদ, ক্যারাভান ৭১, কখনো আধারে নিশি, রুপকথা, নীল খাম, সেদিন তারাবানু আজ তারাবানু, সবকিছু ভেঙ্গে যায়, নয়নতারা ইত্যাদি। বিপ্লবের পরিচালনায় জনপ্রিয়তা পাওয়া ধারাবাহিক নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘কঙ্কাবতী’. ২৬ পর্বে এই ধারাবাহিক নাটকটি চিত্রায়িত হয় থাইল্যান্ডের কোসামতে। এছাড়াও এটুআই বাংলাদেশের প্রযোজনায় ২০১৬ সালে বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডে প্রচারিত ‘সাহেলা বুবুর বৈঠকখানা’ শীর্ষক ১৩ পর্বের ধারাবাহিক নাটকটি বেশ প্রশংসিত হয়।
আবু সুফিয়ান বিপ্লব জানালেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও উন্নয়ন সংস্থার হয়ে ডকুমেন্টারির পাশাপাশি ফিকশনভিত্তিক ডকুড্রামাও নির্মাণ করেছেন। যেগুলোতে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী, ফারাহ রুমা, শাহনাজ খুশি, প্রাণ রায়, দিপা খন্দকার, লিটু আনাম, জোতিকা জ্যোতি, হুমায়ারা হিমু, রোকেয়া রফিক বেবী, ফজলুল রহমান বাবু, রহমত আলি, জিয়ায়ুল ইসলাম কিসলু, তারিক আনাম খান, পাভেল আজাদ, ডা. এজাজ, চিত্রনায়িকা চম্পার মতো তারকাশিল্পী।
ইউএনডিপির প্রযোজনায় আবু সুফিয়ান বিপ্লব নির্মিত ‘আমাদের গ্রাম আদালত’ ও ‘বাড়ির কাছে গ্রাম আদালত’ শীর্ষক সচেতনামূলক ডকুড্রামা দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রদর্শিত হয়েছে। সম্প্রতি এটুআই ও ইউএনডিপি বাংলাদেশের জন্য এই মহামারি কভিড-১৯ এর মধ্যে অনলাইনে শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং মাদ্রাসা বোর্ডের জন্য তিনি নির্মিত প্রায় আটশ’ অনলাইন ক্লাসভিত্তিক ভিডিও, যা সংসদ টিভি ও কিশোর বাতায়ন ফেইসবুক পেইজে সম্প্রচার হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের ‘ভোট ও ভোটার আইডিকার্ড’ নিয়ে নির্মাণ করেন ১১টা টিভিসি। এর বিভিন্ন পর্বে অভিনয় করেন মাশরাফি বিন মর্তুজা, আশরাফুল, হুমায়ন ফরিদী, আফজাল হোসেন, প্রয়াত নায়ক মান্না, নায়ক ফেরদৌস, নায়িকা শাবনুর, মৌসুমি, পপি, সঙ্গীতশিল্পী মমতাজ, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ প্রমুখ। নির্মাণ করেছেন সুন্দরবন সুরক্ষায় জন্য সচেতনামূলক দুটি ভিডিও ‘সুন্দরবন মায়ের মতন’ ও ‘জামতলার রানী’।
কাজের প্রয়োজনে সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে আবু সুফিয়ান বিপ্লব বলেন, বিভিন্ন জনপদে দেখেছি লড়াকু মানুষের বিচিত্র জীবন আর অস্তিত্ব রক্ষায় জীবিকার লড়াই। অঞ্চল থেকে অঞ্চলে মানুষের পাল্টে যাওয়া আচরণ-ভাষা-ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে। মানুষ দেখতে আমার ভালো লাগে, মানুষের সঙ্গে থাকতে আমার ভালো লাগে। মানুষই আমাকে উৎসাহ যোগায় কাজে।
বিপ্লব জানালেন, তার কাজের শুরুটা হয় প্রাইভেট সেক্টর দিয়ে। শুরুতেই গ্রামীণফোনের জন্য অনেক টিভিসি, ডকু-ড্রামা, ডকুমেন্টরি, ইভেন্ট করেছি। গ্রামীণফোনের হয়ে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম. তামিম ইকবাল, নাসির হোসনে, তাসকিন আহমেদ, এনামুল হক বিজয়, আফতাব আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক এদের নিয়ে টিভিসি নির্মাণ করেন। রবি, এয়ারটেল ও বাংলালিংককের সঙ্গেও রয়েছে কাজের অভিজ্ঞতা।
দেশের দক্ষিণপ্রান্তে সাম্প্রতিক কাজের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বৈশ্বিক মহামারির মাঝেও দেশের পাহাড়ি জনপদে সংঘাত থেমে নেই। সেই ঝুঁকির মধ্যেই কাজ করে এলাম খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজার এলাকায়। এরমধ্যে চাকমা সম্প্রদায়ের স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে প্লান ইন্টারন্যাশনালের জন্য তৈরি করলাম ১০টি প্রামাণ্যচিত্র। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে অবহেলিত পাহাড়ি জনপদে নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিবাহ রোধ, গর্ভকালীন সেবা ও পরবর্তী সেবা, যৌতুক, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, কিশোর-কিশোরীর সেবা ইত্যাদি। পাশাপাশি বসতিচ্যুত হয়ে বাংলাদেশ আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিয়েও কিছু কাজ করি। রোহিঙ্গারা এদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই অবশ্য তাদের জন্য উন্নয়নভিত্তিক নানা কার্যক্রম জড়িত হই। রোহিঙ্গাদের মানবিক জীবনযাপন ও সচেতনতায় স্বাস্থ্যবিধি, পরিবার পরিকল্পনা, পাচার, নারী নির্যাতন, গর্ভকালীন সেবা, শিশুসেবা ও জীবন দক্ষতাসহ নানা বিষয়ে ভিডিও নির্মাণ করি। যদিও সব কাজ আমাদের গণমাধ্যমে প্রচারের আলোয় আসেনি। তবুও অস্তিত্বের প্রয়োজনে অবিরাম লড়াই করা প্রান্তিক মানুষদের কাজ করার মধ্যে অন্যরকম আনন্দ খুঁজে পাই।
টিভিনাটক বা ফিকশন নির্মাণ থেকে দূরে থাকা কেন? জবাবে বিপ্লব বলেন, ঠিক দূরে থাকা নয়। ব্যাটেবলে ঠিক মিলছে না বলেই সাময়িক বিরতি। আসলে বর্তমানে নাটক বা ফিকশনের জন্য যে বাজেট ধার্য্য থাকে তা দিয়ে সবদিক ঠিকঠাক রেখে মানসম্পন্ন প্রডাকশন তৈরি করা কঠিন। অনেক নির্মাতাই বাধ্য হয়ে জোড়াতালি বা গোজাঁমিল দিয়ে কাজ করছেন। এ ধরনের কাজে মন টানে না, তাই আপাতত ফিকশনে যাচ্ছি না। আশাবাদি আমি বিশ্বাস করি, ক্রান্তিকালীন একটা সময় পার করছে আমাদের ভিজ্যুয়েল মিডিয়া। এই সংকট থাকবে না। আমাকেও ফিকশনে ফিরতে হবে। ইচ্ছে আছে, সিনেমার বানানোর। এজন্য নিজেকে আস্তে আস্তে প্রস্তুত করছি। প্রাথমিক কাজ শিগগিরই শুরুর ইচ্ছে আছে। পাশাপাশি একটা থিয়েটার কোম্পানি করতে চাই। থিয়েটারকে পেশা হিসেবে নেয়ার প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে কিছু করতে চাই।
শিল্পজমিনে আবু সুফিয়ান বিপ্লবের পদচারণা থিয়েটারের মাধ্যমে। দৃষ্টিপাত নাট্যসম্প্রাদায়ের হয়ে নাট্যচর্চায় হাতেখড়ি হয়। স্বার্থকতা খুঁজে পান প্রয়াত নাট্যজন এসএম সোলায়মানের সংস্পর্শে থিয়েটার আর্ট ইউনিটে। দলটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে নিবেদিত রয়েছেন এখন পর্যন্ত। দুই নাট্যদলের হয়ে অভিনয় করেছেন ‘ইচ্ছমতির কিচ্ছা’. ‘তিন পুরুষের মাথা, ‘রাজার হলো সাজা’, ‘সময়ের প্রয়োজনে’, ‘আমিনা সুন্দরী’, কোর্ট মার্শাল প্রভৃতি নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি আলোক পরিকল্পনার কাজটিও করছেন নিয়মিত। নিজ দলের বাইরেও একাধিক কাজ করছেন। ঢাকা প্রভাকরের প্রযোজনায় তার নির্দেশনায় মঞ্চে আসে বিপুল হাসান রচিত ‘হাঁও মাঁও খাঁও’ এবং আবদুল হালিম আজিজ রচিত পথনাটক ‘রাজার হলো সাজা’ ।
অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিপ্লব মানেন, একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রয়াত নাট্যজন এস এম সোলায়মানকে। তিনি বলে, গুরুর হাত ধরেই আমার মিডিয়ার কাজে যুক্ত হওয়া। তার অনুপ্রেরণাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত অভিনয়শিল্পী হয়েছি। ইচ্ছে ছিল অভিনয় নিয়েই থাকার, গুরুর উৎসাহেই হয়ে গেলাম নির্মাতা। এখনও অবশ্য অভিনয় করছি নিজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে বা অন্য নির্মাতাদের কাজে।
দুই সন্তানের জনক আবু সুফিয়ান বিপ্লবের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায়। তবে বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরেই। স্ট্যাম্পফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিল্ম এন্ড মিডিয়ায় মাস্টার্স করা এই নির্মাতা সংসারের দায়িত্বটা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছেন গৃহিনী স্ত্রী রুমা আক্তারের ওপর। সন্তানদের বড় করে তোলার বিষয়ে দুজনই সহমত, নিজেদের ইচ্ছে মতোই ছেলেরা যেন নিজেদের গড়ে তুলতে পারে। তারা যেন সততা নিয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠে।
সবশেষে প্রযুক্তির নিত্য বাঁক পরিবর্তনের এই যুগে দাঁড়িয়ে আমাদের মিডিয়া আগামী দিনে কোনপথে যাবে জানতে চাইলে বললেন, সময়ের সঙ্গে আমরা যতোটা পারি তাল মিলিয়ে চলছি। ক্যাসেটের যুগ থেকে এখন আমরা ডিভাইসের যুগে চলে এসেছি। সেই এনালগ প্যানেল থেকে এখন ডিজিটাল প্যানেলে কাজ করছি। আমি আশাবাদি, প্রযুক্তির গতি আমাদের পিছনে ফেলতে পারবে না।আমাদের নির্মাতাদের মধ্যে সেই উদ্যম আছে। একই সঙ্গে অবশ্য মনে কিছু শঙ্কাও আছে। যেভাবে আমরা হাতের মুঠোর চার থেকে ৬ ইঞ্চির ভেতর ঢুকে যাচ্ছি, মোবাইল ফোনের মধ্যে সব কিছু দেখে ফেলতে চাচ্ছি এবং পারছি, এতে আগামীতে আমাদের মিডিয়াও মুঠোবন্দি হয়ে পড়ে কিনা সেটা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পূর্বপশ্চিমবিডি/জেআর
Post Written by :
Original Post URL : https://ppbd.news/entertainment/176790/আবু-সুফিয়ান-বিপ্লব
Post Come trough : PURBOPOSHCIMBD