বাংলাদেশ কি লিচেনস্টেইন এর মতো ধর্ষণমুক্ত হতে পারে না?
এ বি এম কামরুল হাসানঅস্ট্রেলিয়া প্রবাসী অগ্রজ চিকিৎসক ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টনের আমি ভীষণ ভক্ত। পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর যে কোন লেখা আমি এক দমে পড়ে ফেলি। এই ভক্তি গড়ে উঠেছে এক এগারোর সময় থেকে। সেসময় তিনি প্রায় প্রতিটি ক্ষুরধার লেখায় আজকের প্রধানমন্ত্রী, সেদিনের গৃহবন্দী নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যার মুক্তি দাবি করতেন। তাঁকে ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের সময়ে নেত্রীর মুক্তি আন্দোলনের সামনের সারির কলমযোদ্ধা বললে অতুক্তি হবে না। কদিন আগে একটি জাতীয় পত্রিকায় মিল্টন ভাই এর একটি লেখা পড়লাম। শিরোনাম ‘দেশে কি ধর্ষণ হঠাৎ করে বেড়ে গেলো?’ তিনি লিখেছেন, ‘দেশে শতকরা আশিটি ধর্ষণের কথা প্রকাশই পায় না। বাকী শতকরা বিশটি ধর্ষণের মধ্যে আদালতে মামলা পর্যন্ত গড়ায় দশটা। তার মধ্যে শতকরা পাঁচটা ক্ষেত্রে ধর্ষকের শাস্তি হয়’।
লেখাটি পড়ে আমিও ভাবনায় পড়ে গেলাম। এর মাঝে ফেসবুক খুললে, পত্রিকার পাতায় ক্লিক করলেই দেখি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই, আইনমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই, সরকারের পতন চাই, ছবিতে অগ্নিসংযোগ। আরো কত কি ! ধর্ষণ বিষয়ে বিশ্ব পরিস্থিতি জানতে গুগলের আশ্রয় নিলাম। গুগল ঘেটে বুঝলাম, শুধু দেশ নয়, পুরা পৃথিবীটাই আসলে ধর্ষণময় হয়ে গেছে। বিশ্বে শতকরা ষাট ভাগের বেশি ধর্ষণের কথা প্রকাশ পায় না। শতকরা দশ ভাগেরও কম আইন আদালত পর্যন্ত গড়ায়। যেগুলো ঘটনা প্রকাশ পায় তার ভিত্তিতেই এসব তথ্য। বোঝায় যায়, বাংলাদেশ বিশ্ব পরিস্থিতি থেকে ভিন্নতর কিছু নয়। এসব তথ্য 'ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ' নামের একটি সাইট থেকে নেয়া। বাংলাদেশের মত অন্যান্য দেশেও অনেক মহিলাই যৌন সহিংসতার ঘটনা খুব কমই রিপোর্ট করেন বা তাদের ঘটনাগুলি সম্পর্কে এগিয়ে আসেন।
উল্লেখিত তথ্যভাণ্ডার মতে, বিশ্বে ধর্ষণের হার সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ আফ্রিকায়, লাখে একশ বত্রিশ। বাংলাদেশের অবস্থান একচল্লিশতম, লাখে নয় দশমিক আট। উরুগুয়েতে নয় দশমিক আট, জার্মানিতে নয় দশমিক চার, নেদারল্যান্ডে নয় দশমিক দুই- আমাদের কাতারেই আছে। অনেকে চমকে উঠবেন, যেসব দেশকে আমরা সভ্য হিসাবে জানি সেখানেও ধর্ষণের হার আমাদের থেকে অনেক বেশি। যেমন সুইডেনে তেষট্টি, অস্ট্রেলিয়ায় আটাশ, আমেরিকায় সাতাশ, নিউজিল্যান্ডে পঁচিশ, নরওয়েতে উনিশ, ফ্রান্সে ষোল। এসব হিসেব প্রতি লাখে। ধর্ষণবিহীন দেশ দুনিয়াতে এখন আছে একটাই। নাম লিচেনস্টেইন। সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার মাঝে আটত্রিশ হাজার লোকসংখ্যার এদেশে এখন ধর্ষণের কোন বালাই নেই। ছোট দেশ, সবাই সবাইকে চিনে তাই কোন ধর্ষণের ঘটনা নেই, এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, শতকরা সত্তর ভাগ ধর্ষণের শিকার কেউ জানেন ও চিনেন- এমন ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত হয়।
লিচেনস্টেইনে ২০০৪ থেকে ২০১৪ সময়কালে ধর্ষণের হার যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০০৫ সালে দেশটিতে ধর্ষণের হার ছিল লাখে এগারো দশমিক পাঁচ। ২০১৪ সালে এ হার ছিল সর্বোচ্চ, লাখে তেরো দশমিক চার। ২০১৫ সালে একটিমাত্র ধর্ষণের ঘটনা সংঘটিত হয়। বর্তমানে শূন্য। এটি সম্ভব হয়েছে সেখানে আইনের ব্যাপক সংস্কার, শাস্তির পরিমাণ বাড়ানো ও তার প্রয়োগ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে। ধর্ষণ সেখানে একটি ফৌজদারি অপরাধ। সরকার এ জাতীয় অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে মামলা করছে। অভিযুক্তদের সুরক্ষা দিচ্ছে, আইনি পরামর্শ দিচ্ছে, দিচ্ছে সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানবিক ও চিকিৎসা সহায়তা। ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শাস্তি এক থেকে পনেরো বছর। ধর্ষণের পর যদি হত্যা করা হয় তাহলে দশ বছর থেকে আজীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। মোদ্দা কথা শাস্তির পরিমাণ নয়, শাস্তি নিশ্চিতকরণই এ সাফল্যের মূলমন্ত্র।
ধর্ষণ বা নারী নির্যাতন শুধু বাংলাদেশেই নয়, এটি এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। সুতরাং, এটি নিয়ে রাজনীতি না করে সমাধানের কথা ভাবুন, বলুন, কিছু করুন। বিশ্বময় এ সমস্যা সমাধানে জাতীয় ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার কথা ভাবা জরুরি। আশার কথা, জাতিসংঘের ঢাকা অফিস এক বিবৃতিতে পদ্ধতিগত সংস্কারের সুনির্দিষ্ট আহবান জানিয়েছে। বৈশ্বিক এ সংস্থাটি নারী ও শিশু নির্যাতন পুনমূল্যায়নের ক্ষেত্রে ও মামলা পরিচালনার পদ্ধতিতে সরকারকে সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছে। ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের সুরক্ষা প্রদান এবং বিচারের ক্ষেত্রে দ্রুততা আনতে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার জরুরি সংস্কারের তাগিদ দিয়েছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের কথা ভাবছে সরকার। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ধর্ষকদের কঠোর শাস্তির পাশাপাশি তাদের আশ্রয় দাতাদেরও ছাড় দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন। নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আমরাও চাই উপযুক্ত বিচার হোক।
সবার ভেতর একটা পজিটিভ দিক পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটি আশার কথা। এখন দরকার সমন্বয়। জাতিসংঘের গাইড লাইন মেনে নারী অধিকার সুরক্ষায় দ্রুত পদ্ধতির সংস্কারের কথা ভাবুন। সব প্রকাশিত ধর্ষণ ঘটনার শাস্তি নিশ্চিত করুন। আইন পরিবর্তন করুন। আইন তো মানুষের জন্যই। মানুষ চাইছে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হোক। প্রয়োজনে ধর্ষণের ব্যপারে লিচেনস্টেইনের আইন ও তার প্রয়োগ কৌশল পর্যালোচনা করা যেতে পারে। প্রতিটি বিবেকবান মানুষ চায়, বাংলাদেশ লিচেনস্টেইন এর মতো হোক যেখানে এখন ধর্ষণের হার শূন্য।
লেখকঃ প্রবাসী চিকিৎসক, কলামিস্ট
পূর্বপশ্চিমবিডি/এসএম
Post Written by :
Original Post URL : https://ppbd.news/open-views/176274/বাংলাদেশ-কি-লিচেনস্টেইন-এর-মতো-ধর্ষণমুক্ত-হতে-পারে-না?
Post Come trough : PURBOPOSHCIMBD