জনপ্রশাসন অথবা নাগরিক সেবায় ‘উদ্ভাবন’ ধারণাটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে আলোচিত। বাংলাদেশ জনপ্রশাসনে বিগত দশ বছরে এ-সংক্রান্ত আলোচনা ও চর্চা শুরু হয়েছে। দিন বদলের সনদ দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণের দোড়গোড়ায় সেবা পৌঁছে দেবার প্রত্যয় দিয়ে এর সূচনা করে। নাগরিকের সেবা প্রদান পদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় সরকারি ও বেসরকারি খাত দুটোই উঠে আসে। কিন্তু দেশের বর্তমান সময় ও অবস্থান বিবেচনায় এখনো সরকারই সবচেয়ে বড় সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। দেশের বৃহৎ নাগরিক সমাজ তাদের প্রাত্যহিক প্রয়োজনে সরাসরি সরকারি সেবার ওপর নির্ভশীল। সে বিবেচনায় এবং সময়ের কথা মাথায় রেখেই আজকের আলোচনা মূলত সরকারি সেবায় তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
সরকার ২০১২ সালে গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট প্রতিষ্ঠা করে। ই-গভর্নেন্স বিষয়ক প্রকল্প ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রাম’ নাগরিক সেবায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নাগরিক সেবায় উদ্ভাবনের ধারণাটিকে জনপ্রিয় করে তোলে। সকল মন্ত্রণালয় / বিভাগ, অধিদপ্তর / সংস্থা এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একটি করে ‘ইনোভেশন টিম’ গঠনের নির্দেশনাসূচক ৮ এপ্রিল ২০১৩ তারিখ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত সার্কুলারের মাধ্যমে জনপ্রশাসনে উদ্ভাবনী চর্চার বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট ও অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রাম এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বর্তমানে জনপ্রশাসনে নাগরিক সেবায় উদ্ভাবনী চর্চার সুযোগ তৈরি করার জন্য কাজ করছে।
সরকারি খাতে উদ্ভাবন কি?
‘উদ্ভাবন’ বা ‘ইনোভেশন’-এর ধারণাটি মূলত বেসরকারি খাত থেকে এসেছে। সরকারি খাতে এর সংজ্ঞা, প্রয়োগ ও পরিব্যপ্তি নিয়ে তাত্ত্বিকগণের বিভিন্ন মত ও পর্যালোচনা রয়েছে। পৃথিবীব্যাপী সরকারি খাতে উদ্ভাবন বিষয়ক একক বা সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নাই। বরং উদ্ভাবন প্রত্যয়টির প্রয়োগ এবং সংজ্ঞা উভয়ই প্রাসঙ্গিক বিষয় বা পরিপ্রেক্ষিতকেন্দ্রিক। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল অডিট অফিসের এক প্রতিবেদনে সরকারি পর্যায়ে উদ্ভাবন বলতে বোঝানো হয়েছে :
* অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান, সেক্টর বা দেশ হতে কোন সৃজনশীল চর্চা নিজ ক্ষেত্রে অনুকরণ করা; অথবা
* সম্পূর্ণ নতুন একটি চর্চার অবতারণা করা; যা প্রশাসনিক পদ্ধতি অথবা সেবা প্রদানের প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। এটি ছোটখাটো পরিবর্তন হতে পারে, যা ক্রমাগতভাবে বিদ্যমান ব্যবস্থা ও পদ্ধতির ধারাবাহিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
আইডিইও (www.ideo.org) এর মতে, উদ্ভাবন বলতে কোনো পণ্য বা পদ্ধতি বা সেবার উন্নয়ন বা অভিযোজন বা প্রবর্তন বোঝায় যা জনগণের জন্য নতুন সুবিধা বা উপকার তৈরি করে। উদ্ভাবনী উদ্যোগে সৃজনশীলতা প্রয়োজন। তবে সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবন এক নয়। যেখানে সৃজনশীলতা প্রধানত মনোজাগতিক ও ধারণাকেন্দ্রিক, সেখানে উদ্ভাবন প্রায়োগিক বা চর্চাকেন্দ্রিক। অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রাম সেবাগ্রহীতার প্রেক্ষাপট থেকে নাগরিক সেবায় উদ্ভাবনকে বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ করতে আগ্রহী।
নাগরিক সেবায় উদ্ভাবন বলতে সেবা প্রদান প্রক্রিয়ায় এমন কোনো পরিবর্তনের সূচনা করা, যার ফলে সংশ্লিষ্ট সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে নাগরিকের আগের তুলনায় সময়, খরচ ও অফিস যাতায়াত সাশ্রয় হয়। তবে বিদ্যমান চর্চায় পরিবর্তন হোক বা অন্যত্র থেকে নিজ ক্ষেত্রে অনুকরণ করা চর্চা হোক বা সম্পূর্ণ নতুন কোনো চর্চা হোক না কেন, জনপ্রশাসনে উদ্ভাবন এমন একটি বিষয় যা নিজ অধিক্ষেত্রে নতুন বা পরিবর্তিত অবস্থার সৃষ্টি করে এবং এর ফলে নতুনভাবে জনসুবিধা বৃদ্ধি পায়। এটি এমন নতুনত্ব যা এর আগে নিজ অধিক্ষেত্রে প্রয়োগ বা চর্চা হয়নি। ইনোভেশন নির্দিষ্ট একক কোনো সরল রেখায় চলে না। এক্ষেত্রে ব্যর্থতা এবং সফলতা উভয়েরই সমান সুযোগ রয়েছে।
সরকারি খাতে উদ্ভাবনের ক্ষেত্র ও জীবনচক্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক প্রতিবেদনে সরকারি পর্যায় উদ্ভাবনের যে ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম :
* সরকারি কর্মপদ্ধতিতে উদ্ভাবন, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে দক্ষতার বৃদ্ধি;
* পণ্যের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন;
* সেবার ক্ষেত্রে উদ্ভাবন;
* সেবাগ্রহীতাদের সাথে যোগাযোগের পদ্ধতি বা প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে উদ্ভাবন; এবং
* নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন।
এ প্রতিবেদন মতে উদ্ভাবনের নিম্নরূপ একটি জীবনচক্র রয়েছে :
যেহেতু নতুন নতুন বিষয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা যাচাই-বাছাই করা হয়, সেহেতু এর প্রক্রিয়ায় ব্যর্থতার ঘটনা ঘটাও স্বাভাবিক। ইনোভেশনের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ঝুঁকি মোকাবেলার প্রবণতা / মানসিকতা থাকতে হয়।
সরকারি খাতে উদ্ভাবনী ধারণার উৎস
তাত্ত্বিকগণের আলোচনা এবং এ-সংক্রান্ত গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায় যে, সরকারি খাতে উদ্ভাবনী ধারণা ও উদ্যোগ ঐতিহ্যগতভাবে উচ্চপর্যায় থেকে এলেও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা গেলে এটি নিম্নপর্যায়ের গণকর্মচারীগণের নিকট থেকে অধিক হারে আসতে পারে। উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে যে উদ্ভাবনী উদ্যোগ নেয়া হয় তা প্রধানত নীতি-নির্ধারণী বিষয়ক ও তা ম্যাক্রো প্রকৃতির সমস্যা সংশ্লিষ্ট। অন্যদিকে, নিম্নপর্যায় থেকে আগত উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আকারের এবং স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যাকেন্দ্রিক; যা সরাসরি প্রান্তিক সেবাগ্রহীতার জন্য নতুন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে। আর এ ধরনের উদ্যোগগুলো কম প্রচার বা প্রসার লাভ করে। এছাড়া, বেসরকারি খাত, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ নাগরিক থেকেও সরকারি উদ্ভাবনের ধারণা আসার বৃহত্তর সুযোগ বিদ্যমান। বিশেষত সমস্যা চিহ্নিতকরণ, উদ্ভাবনী ধারণার সঞ্চালন, উদ্ভাবনী প্রকল্পের ডিজাইন ও পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং মূল্যায়ন তথা সমগ্র উদ্ভাবন চক্রে সেবগ্রহীতার সরাসরি সংশ্লিষ্টতাকে বর্তমানে সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়।
সরকারি খাতে উদ্ভাবনের চালিকাশক্তি
সরকারি পর্যায়ে উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী নেতৃত্ব, জনপ্রশাসনে উদ্ভাবনী সংস্কৃতি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, গণকর্মচারীগণের দক্ষতা, প্রণোদনা, এবং ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতাকে জরুরি বলে মনে করা হয়। জনপ্রশাসনে উদ্ভাবনী সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান কমিশন নি¤েœর বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্বারোপের পরামর্শ প্রদান করে।
* উদ্ভাবনী ধারণার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের সহযোগিতা;
* উদ্ভাবনী উদ্যোগের সাথে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাগণের সক্রিয় সম্পৃক্তি;
* উদ্ভাবনী উদ্যেগের জন্য প্রণোদনা;
* উদ্ভাবনী উদ্যোগ পরিকল্পনায় সেবাগ্রহীতার সম্পৃক্তি; এবং
* উদ্ভাবনী উদ্যোগের বাস্তবায়নোত্তর মূল্যায়ন।
জনপ্রশাসনে উদ্ভাবন সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তাগণকে পৃষ্ঠপোষকতা এবং উৎসাহিত করা প্রয়োজন। আর উদ্ভাবনের সফলতার জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধান বা টিম লিডারের অবশ্যই সরকারি খাতে উদ্ভাবন সম্পর্কে, উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সম্পর্কে, অভীষ্ঠ গোষ্ঠীর সমস্যা ও চাহিদা, এবং প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দ্যেশ্যের আলোকে কোথায় কখন উদ্ভাবন দরকার, সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ও পরিপূর্ণ ধারণা থাকা দরকার।
উদ্ভাবনের সাথে তথ্য ও প্রযুক্তি
নাগরিক সেবায় ‘উদ্ভাবন’, এই কথার সাথে অনেকগুলি ফ্যাক্টর সরাসরি জড়িত। উদ্ভাবন মানেই যে সেটি প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে, এমন কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। কোনো কোনো উদ্ভাবনের সাথে অবকাঠামোগত পরিবর্তন, সার্ভিস প্রসেস ইত্যাদি সরাসরি জড়িত। ফলে প্রতিটি নাগরিক সেবায় যে প্রযুক্তিনির্ভর হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায় যে, প্রসেস উদ্ভাবন, ডিভাইস উদ্ভাবন এবং অবকাঠামোগত উদ্ভাবন। প্রতিটি উদ্ভাবন কোনো না কোনোভাবে নাগরিক সেবার উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। কিন্তু প্রক্রিয়াগত কারণে সবক’টির সেবা প্রদান পদ্ধতিতে সমান নয়। বিশেষত সুশাসন প্রতিষ্ঠার দিক বিবেচনায় এর বিভিন্ন কম্পোনেন্টের জায়গায় তথ্য ও প্রযুক্তি বিশেষ ভূমিকা রাখে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে দুর্নীতি প্রতিরোধ করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে তথ্য ও প্রযুক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
এটুআই’র গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তার অবসরকালীন ভাতা তুলতে প্রায় ২১ ধরনের কাগজ জমা দেন। এতে প্রচুর সময় ও অর্থ খরচ হয়। সাথে থাকে ভোগান্তি। অথচ এই সেবা প্রক্রিয়া সহজীকরণ করার ফলে সকল তথ্য দেবার জন্য মাত্র ৮ ধরনের কাগজ জমা দেবার বিধান করা হয়। ফলে খুব দ্রুততম সময়ে পেনশন মঞ্জুর করা সম্ভবপর হয়। মজার বিষয় হলো, যদি এই কাজটি অনলাইনে মানে তথ্য ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে করা সম্ভবপর হয়, তাহলে এর জন্য দরকার হবে মাত্র ৪ ধরনের কাগজ। ফলে নাগরিক ভোগান্তি বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। সেবা প্রদানে সময় বাঁচে, কম খরচ হয় এবং ঘোরাঘুরিরও প্রয়োজন কমে যায়।
নাগরিক সেবায় তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার তাই ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। আমাদের দেশের বিভিন্ন দপ্তরের প্রচলিত সেবাগুলো চিহ্নিত করা এবং নাগরিক ভোগান্তি কমাতে সে স্থলে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী উদ্যোগ নিয়ে তাতে তথ্য ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো মাঠপর্যায়ে কর্মরত সরকারি কর্মচারীরা তাদের মেধা ও মনন দিয়ে এই সহজীকরণের কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটি একটি মাঠপর্যায়ে কাজের অংশ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে, ফলে সেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে, কমেছে জনভোগান্তি।
নাগরিক সেবায় তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার
ই-গভর্নমেন্ট মাস্টার প্ল্যান প্রকল্পের আওতায় সরকারের ৫২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, ৬৮টি অধিদপ্তর এবং সংস্থাসমূহকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডিজিটাল আর্কিটেকচারের মধ্যে আনার জন্য একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ই-গভর্নেন্স ইন্টারপারেবিলিটি (ইন্টেরোপিরাবিলিটি) ফ্রেমওয়ার্ক প্রস্তুত করা হয়েছে। আজ ডিজিটাল স্বাক্ষর ও সার্টিফিকেট সেবা আমাদের সরকারি কাজে সহজেই প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। সেবা প্রদান পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে আমূল। নিজে উপস্থিত হয়ে অফিস চলাকালীন সেবা প্রদানের প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে ভেঙে ২৪ ঘণ্টা সেবা প্রদানের জন্য চালু হয়েছে কল সেন্টার। ৩৩৩, ৯৯৯, ১০৬, ১৬২৬৩, ১০৫, ১৩১, ১৬১২৩ এর মতো আরো অনেক কল সেন্টার এখন সারাদিন সারারাত জনগণকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থাপন করা হয়েছে “ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার”। সারাদেশে প্রায় ৫ হাজারের বেশি ডিজিটাল সেন্টারে ১০ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা প্রায় ১৫০ ধরনের সেবা ইউনিয়ন পর্যায় থেকে প্রদান করা হচ্ছে (করে যাচ্ছে)। এ পর্যন্ত ৪২২ কোটি সেবা প্রদান করা হয়েছে, আয় হয়েছে প্রায় ৩৪০ কোটি টাকা। এই সেবাকে একীভূত করে “একসেবা” নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা হয়েছে। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে থেকে কৃষক এখন সহজেই তার পণ্য কেনাবেচা করতে পারেন। ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে এই পর্যন্ত প্রায় ৩৫৭ কোটি টাকারও অধিক রেমিটেন্স উত্তোলন করা হয়েছে। ২ হাজার ১০৭ কোটি টাকারও বেশি আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে। চারটি জেলার ১১টি উপজেলায় ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষকে বিভিন্ন ভাতা প্রদান করা হয়েছে। ডিজটাল সেন্টার এ এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম চলমান আছে। বিকাশ, নগদ কিংবা রকেটের মতো সেবাগুলো দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তথ্য প্রাপ্তির জন্য বিশ্বের অন্যতম বড় প্ল্যাটফর্ম www.portal.gov.bd তে ২৫ হাজারেরও বেশি ওয়েব পোর্টাল সংযুক্ত রয়েছে। ৩১ হাজার ৮২৪টি সরকারি ওয়েবসাইট ৪৬ হাজারেরও বেশি অফিস তথ্য বাতায়নে যুক্ত। প্রতি মাসে প্রায় ৬ কোটি মানুষ এখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। ৬০০-এর বেশি ই-সেবা এখানে পাওয়া যায়। ১৬৫০টির বেশি সরকারি ফরম এখানে সংযুক্ত থাকায় সেবা প্রাপ্তি সহজ হয়েছে। নাগরিকের সকল প্রকার তথ্য ও সেবা প্রাপ্তির জন্য সর্বোচ্চ অফিস থেকে একেবারে তৃণমূলের ইউনিয়ন অফিস এতে একই সাথে সংযুক্ত আছে। কৃষি বাতায়নে (http://krishi.gov.bd/) সংযুক্ত হয়েছে ৭৮ লাখ কৃষক। মাঠপর্যায়ের ১৮ হাজার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা এখানে সংযুক্ত আছেন। হাটবাজার, বালাইনাশক, কৃষক সংগঠন প্রভৃতির তথ্য এই বাতায়নকে সমৃদ্ধ করেছে। শিক্ষক বাতায়নে (www.teachers.gov.bd) তে যুক্ত রয়েছেন প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার শিক্ষক। মডেল কন্টেন্ট রয়েছে ৯৪৩টি আর শিক্ষামূলক কন্টেন্ট রয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ২২০টি। করোনাকালীন ঘরে থাকার এই সময়ে তথ্য ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে শিক্ষা চলমান রাখতে এই বাতায়ন কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। শিক্ষাকে প্রাণবন্ত করে উপস্থাপনার জন্য মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুমের ভূমিকা আবারো তথ্য ও প্রযুক্তির গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
বাড়িতে বসে থেকেও কিংবা অন্য যে কোনো জায়গা থেকে নথি নিষ্পত্তির যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে প্রায় ৪৬০০-এর বেশি সরকারি দপ্তরে চালু হয়েছে ই-নথি। ৫৬ হাজারের বেশি ব্যবহারকারীর মাধ্যমে এই সিস্টেমে প্রায় ৪২৬ মিলিয়ন নথি নিষ্পত্তি হয়েছে। সেবা প্রদানে এই এক অনন্য অসাধারণ প্রযুক্তির ব্যবহার। ই-নামজারির মাধ্যমে ভূমি ক্ষেত্রে জটিলতা নিরসনে নিয়মিত কার্যক্রম সাধারণের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। আরএস খতিয়ান অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। এই সিস্টেমে ৫৩ জেলার ১ কোটি ১১ লাখেরও বেশি আরএস খতিয়ান অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। ৪ কোটির বেশি খতিয়ান ডিজিটালাইজড করা হয়েছে ডিজিটাল রেকর্ড রুমের মাধ্যমে। তথ্য ও সেবা নিতে সকল সরকারি ফরম নিয়ে তৈরি হয়েছে ফরম বাতায়ন। ২৭৮টি অফিসের ১৬৭৯টি ফরম, যার মধ্যে ১২০০-এরও বেশি পূরণযোগ্য পিডিএফ এখানে রয়েছে।
বিচারব্যবস্থা নিয়ে বিচার বিভাগীয় বাতায়ন ও মামলার কার্যতালিকা একত্রিত করে ওয়েবসাইট থেকে সেবাপ্রত্যাশীরা সহযোগিতা পাবেন সার্বক্ষণিক। করোনা পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল জামিন এবং মামলার শুনানি আমাদের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক অনন্য সংযোজন। অনলাইনে অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা সরকারি সেবা ব্যবস্থাতে জনগণের আস্থা বাড়াতে এবং সেবা পেতে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। এ কথা সত্য যে, তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা গেছে অনেকাংশেই।
বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩ কোটি মোবাইল ফোন গ্রাহক ও ৬ কোটি ৭২ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছেন। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ তথা ৬ কোটি ৩১ লাখ গ্রাহকই তাদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এটি ব্যবহার করে থাকেন। সার্বিকভাবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন ও বিকাশে নেয়া উদ্যোগগুলোর ফল এরই মধ্যে আমরা পেতে শুরু করেছি, যা ভবিষ্যতে নিঃসন্দেহে আরো বাড়বে। আশা করা হচ্ছে, দেশে ২০২০ সাল শেষে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে মোট মোবাইল ব্যবহারকারীর ৪৯ শতাংশে উন্নীত হবে। এই হার ২০১৬ সালের শেষে ছিল প্রায় ২২ শতাংশ। মোবাইল ফোনভিত্তিক আর্থিক পরিষেবা যেমন বিদেশ থেকে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় আনয়ন ও স্থানীয়ভাবে অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে রীতিমতো এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে বলা যায়। মোবাইল ফোনে অ্যাপসভিত্তিক সেবা প্রদান নাগরিকের সেবা প্রাপ্তির অন্যতম প্ল্যাটফর্ম হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। রেলসেবা মোবাইল অ্যাপস, কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদভিত্তিক অ্যাপস, এসডিজি ট্রাকার, করোনা ট্রাকার ইত্যাদি নাগরিকের সেবা প্রাপ্তি সহজ করেছে। নিশ্চিত হয়েছে হাতের মুঠোয় সেবা প্রাপ্তি। অ্যাপস ভিত্তিক এই সেবা প্রদান পদ্ধতি বেসরকারি সেবাদানকেও উৎসাহিত করছে। ফলে বৃহৎ পরিসরে নাগরিকের জন্য সেবার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে।
পোস্ট অফিস বা ডাকঘরও এখন তথ্যপ্রযুক্তি সেবার আওতায় চলে এসেছে। সরকার দেশব্যাপী ৯০০০ গ্রামীণ ডাকঘর এবং প্রায় ৫০০ উপজেলা ডাকঘরকে ই-সেন্টারে পরিণত করেছে। ডাকঘরের মাধ্যমে মোবাইল মানি অর্ডার ও পোস্টাল ক্যাশ কার্ডসেবা চালু করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। অনলাইনে সরকারি কর্মচারীদের বেতন প্রাপ্তি, পেনশন নিশ্চিত করা, সঞ্চয়পত্র ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশন করা, ই-চালান, আইবাস++ পদ্ধতি সেবা প্রদানের কাজে গতিশীলতা এনেছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়া কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তির রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন যেমন করা যায় তেমনি পরীক্ষার ফলাফলও প্রকাশ হয়। একইভাবে বিদেশে চাকরির রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন, হজযাত্রার নিবন্ধন, বিভিন্ন ধরনের অফিসিয়াল বা সরকারি ফরম সংগ্রহ, ট্যাক্স বা আয়কর রিটার্ন দাখিল, টেন্ডার বা দরপত্রে অংশগ্রহণ ইত্যাদি কাজ-কর্ম অনলাইনেই সম্পন্ন করা যায়। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশে ডিজিটাল রেনেসাঁ বা নবজাগরণের অল্প কয়েকটি নমুনা।
শুধু তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য ও সেবা চালুর মধ্যেই সীমিত থাকেনি এ-সংক্রান্ত সরকারি-বেসরকারি কার্যক্রম। প্রতিনিয়তই নিত্যনতুন ও অধিকতর উন্নত প্রযুক্তি আসছে। ফলে পুরনো পণ্যসেবাগুলোর জায়গায় হালনাগাদ পণ্যসেবা দ্রুত চালু হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় স্মার্টফোনের সক্ষমতা, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, ক্লাউড কম্পিউটিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, রিয়েল-টাইম স্পিচ রিকগনিশন, ন্যানো কম্পিউটার, উইয়ারেবল ডিভাইস ও নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন, সাইবার সিকিউরিটি, স্মার্ট সিটিজ, ইন্টারনেটÑ এসব পণ্যসেবার বিকাশ ঘটছে। ক্লাউড কম্পিউটিং এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের বিকাশ এই দশকে বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তির দিশা পুরোদমে পাল্টে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা এখন থ্রিডি প্রিন্টিং ও বায়োমেট্রিকস চালুর বিষয়েও জোরালোভাবে কথা বলছেন। অনলাইন কার্যক্রমে এখন যেভাবে নতুন নতুন ডিভাইস, কৌশল ও প্রবণতা ব্যাপক হারে চালু ও বিকশিত হচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের লাইফস্টাইল বা জীবনধারাকে আমূল পাল্টে দেবে বলেই মনে হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফরচুন ম্যাগাজিনের নির্বাচিত বিশ্বের বৃহত্তম ৫০০ কোম্পানির সিইওদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন প্রযুক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। প্রযুক্তি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এই পরিবর্তনের সঙ্গে যারা দ্রুত খাপ খাইয়ে নেবে তারাই এগিয়ে যাবে, আর যারা দেরি করবে তারা ছিটকে পড়বে। প্রযুক্তি ব্যক্তিপর্যায়েও অনেকের জীবনে ক্ষমতায়নের সুযোগ এনে দিয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন ও সামাজিক জীবনে নানা সমস্যার সমাধানেও প্রযুক্তির অবদান রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ২০১৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে (ইউএনজিএ) দেয়া ভাষণে বলেন, প্রযুক্তির প্রচলন ছড়িয়ে পড়ার সুবাদে আজকের দিনে জন্ম নেয়া শিশু তাদের আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা ভোগ করছে। ইউএন ই-গভর্নমেন্ট ডেভেলপমেন্ট র্যাংকিংয়ে ২০১২ সালে ১৪৮তম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ ২০১৮ সালে ১১৫তম অবস্থানে পৌঁছায়। মূলত আইসিটি টুলসকে ব্যবহার করে বিভিন্ন অনলাইন সেবা তৈরি এবং মোবাইল বা ওয়েব অ্যাপসের মাধ্যমে তা উপস্থাপনের জন্য অনলাইন সেবা সূচকে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ক্ষণে আমরা উপস্থিত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে এই মহানায়কের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এই ২০২০ সালে জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় ১০০টি সেবাকে ডিজিটাল সেবায় পরিণত করার কাজ চলছে। নাগরিকের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় এই সেবাগুলোকে চিহ্নিত করে পর্যায়ক্রমে এর উন্নয়ন করা হচ্ছে। ১০টি সেবার ডিজিটালাইজেশন মূল্যায়ন সম্পন্ন হয়েছে। কাউকে পেছনে না ফেলে, সবাইকে নিয়ে শহরের সেবা গ্রামে বিস্তৃত করতে তথ্য ও প্রযুক্তিকে করা হয়েছে হাতিয়ার; যেখানে নাগরিকের প্রশান্তি বিবেচিত হচ্ছে সর্বাগ্রে। সেবা গ্রহণকারী হিসেবে এই পুরো প্রক্রিয়ার সাথে যথাযথভাবে জড়িত হবার মাধ্যমেই নাগরিক তার প্রাপ্ত সুবিধা বুঝে নিতে পারবেন। পূরণ হবে আজন্ম লালিত স্বপ্ন; সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত সোনার বাংলাদেশ। যেখানে লাল-সবুজের পতাকা ওড়াবেন আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মমর্যাদাবান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি ও বাংলাদেশী।
এ কে এম তাজকির-উজ-জামান : অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক ও আইসিটি), চাঁপাইনবাবগঞ্জ