নিজস্ব প্রতিবেদক: তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্র নাচোলে কৃষক ও সাঁওতালদের সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারী কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। পুলিশ ও সেনারা এই বিদ্রোহ দমন করে। তিনি পালানোর সময় বন্দী হন ও রাজশাহী জেলে নির্যাতনের শিকার হন। ইলা মিত্রঃযশোরের বাগুটিয়া গ্রামে আদি নিবাস হলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাসে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। কলকাতা থেকে লেখাপাড়া শেষ করে তিনি ১৯৪৫ খ্রিঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামে আসেন রমেন মিত্রের বধু হিসেবে। ১৯৪৭-৫০ খ্রিঃ নাচোলে অনুষ্ঠিত তেভাগা আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। এজন্য আজও তাঁর কথা মনে রেখেছে এখানকার আবাল-বৃদ্ধ বনিতা।ইলা মিত্র এক সংগ্রামী নাম। এক বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধির নাম। এক মানবতাবাদী নারীর নাম। যিনি সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্বেচ্ছায় জীবনের সকল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছেন। ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন। তবুও থেমে যায়নি তাঁর আদর্শের লড়াই। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্য লড়ে গেছেন সংগ্রামী এই নারী। শত অত্যাচার নীরবে সহ্য করে গণতন্ত্রকামী মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করে মানুষকে আলোর পথ দেখিয়েছেন।মহিয়সী নারী ইলা মিত্রের জন্ম ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার বাগুটিয়া গ্রামে। কিংবদন্তী এই নারীর বাবা ছিলেন নগেন্দ্রনাথ সেন এবং মা মনোরমা সেন। বাবা ছিলেন বেঙ্গলের ডেপুটি অ্যাকাউন্টেট জেনারেল। মা ছিলেন গৃহিনী। শিশুকাল কাটে ইলার গ্রামে। বাবার চাকুরির সুবাদে কলিকাতায় তাঁকে স্কুলে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১৯৪৫ সালে বেথুন কলেজ থেকে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এসময় তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি কলিকাতা মহিলা সমিতির সদস্যপদ লাভ করেন। ‘রাওয়াল বিল’ বা হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০ বছর বয়সে ১৯৪৫ সালে দোল পূর্ণিমার রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার রামচন্দ্রপুরের জমিদার বাড়ির ছেলে রমেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে ইলা সেনের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি ইলা মিত্র নামে পরিচিত হন। স্বামী রমেন্দ্র মিত্র ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য। ইলা ছিলেন ভারতের একজন চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলেট। বাস্কেট বলও ভাল খেলতেন। ১৯৪০ সালে ভারতের হয়ে জাপান অলেম্পিকে খেলতে যাওয়ার জন্য তিনি মনোনীত হয়েছিলেন। এ সময় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে ওই অলিম্পিক বাজেয়াপ্ত হলে তাঁর আর অলেম্পিকে খেলা হয়নি।১৯৪২ সালে এ দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তখন কৃষকদের উপর শোষণের মাত্রা বেড়ে যায়। কৃষকরা শুরু করে ‘তিন ভাগের দুইভাগ ফসল’ এর জন্য আন্দোলন। এই আন্দোলন চলে ভারত পাকিস্তান বিভক্তির পরেও। এই সময় বর্তমান বাংলাদেশে (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। সরকারের দমন পীড়ন নীতির কারণে কমিউনিস্ট ও কৃষক আন্দোলনের নেতারা আত্ম গোপন করেন। ইলা মিত্র এবং রমেন্দ্র মিত্রও নাচোলের চ-িপুর গ্রামে আত্মগোপন করেন। এই গ্রামে ছিল সাঁওতার নেতা ও প্রথম সাঁওতাল কমিউনিস্ট মাতলা মাঝির বাড়ি।তেভাগা আন্দোলন একটি বাস্তব রূপ লাভ করে। কৃষকদের প্রতিরোধের মুখে আপাতভাবে তেভাগা কার্যকর করা হলে ভূমি মালিকরা থেমে থাকেনি। সরকারের আইনশৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনী নানাভাবে কৃষকদের ওপর অত্যাচার নিপীড়ন চালাতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তা ও ৫ জন কনস্টবল নিহত হয় আন্দোলনকারিদের হাতে। এর পরই শুরু হয় পুলিশ ও সৈন্যদের অত্যাচার নির্যাতন।১৯৪৫ সালে বৃটিশ শাসনের শেষ দিকে ইলা মিত্র ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে শ্বশুর বাড়িতে। স্বামী রমেন্দ্র মিত্র এবং তার বন্ধু আলতাফ মিয়া মিলে শুরু করেন একটি বিদ্যালয়। জমিদারবাড়ির অদূরের কৃষ্ণ গোবিন্দপুর স্কুলে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। ৩ জন ছাত্র নিয়ে নিরক্ষরতা দূরীকরণ কাজ শুরু করলেও এক বছর পর স্কুলের ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫ জনে। এই স্কুলকে কেন্দ্র করেই তাঁর সংগ্রামী জীবন শুরু হয়। ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কার্যক্রম শুরু করেন তিনি এবং এসময়ই তিনি মিশে যান কৃষক মজুরদের সঙ্গে। তখন থেকেই ওই এলাকার মানুষ ইলা’কে রাণী মা’ বলে সম্বোধন করতে থাকে।
জমিদার বাড়ির গৃহবধূ হয়েও ইলা স্বামীর সহায়তায় খুব দ্রুত হয়ে ওঠেন স্থানীয় কৃষক সম্প্রদায়ের নেত্রী। স্বামী রমেন্দ্র মিত্র ছিলেন একজন মুক্তমনের স্বাধীনচেতা মানুষ। ফ্লোড কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন এবং কৃষকদের জমি ভাগাভাগির বিষয় দু’টি নিয়ে পুরো দেশ তখন সরকার বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল। নাচোলের কৃষকরাই ছিল আন্দোলনের পুরোভাগে। এই আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিল সাঁওতালরা। এই আন্দোলনই আজ ইতিহাসে ‘নাচোল বিদ্রোহ’, ‘তেভাগা আন্দোলন’ বা ‘নাচোলের কৃষক আন্দোলন’ ইত্যাদি নামে পরিচিত। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ইলা মিত্র। ১৯৪৬ সালে ইলা মিত্র তাঁর দলের সকলকে নিয়ে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রতিহত করার জন্য আন্দোলন করেন।
১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি পুলিশ ও কৃষকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এরই জের ধরে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার দুই দিন পর নাচোলে প্রায় ২ হাজার সেনা প্রেরণ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু সেনারা ওই এলাকায় ব্যাপক মারপিট করে এবং গুলি করে শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করে এবং জ্বালিয়ে দেয় ১২ টি গ্রামের কয়েক’শ বাড়ি-ঘর। এদের বেশীরভাগই ছিল সাঁওতাল অধিবাসী। পাকিস্তানি সৈন্য এবং পুলিশের অত্যাচারে প্রতিটি পরিবারের সকল সদস্য এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। ইলা মিত্রও সাঁওতালদের পোশাক পড়ে পালিয়ে যান। পোষাক পরিবর্তন করলেও ভাষাগত কারণে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ইলা মিত্র তাঁর এক’শ অনুসারিসহ গ্রেফতার হন রহনপুর থেকে।
নাচোল থানায় তাঁর উপর চলে পুলিশী অমানুষিক নির্যাতন। প্রথম ধাপে টানা চার দিন চলে এই নির্যাতন। প্রচ- জ্বর এবং রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে নেওয়া হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ হাসপাতালে। ওই মাসেই ২১ তারিখে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাঁকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর সেখানেই শুরু হয় নির্যাতনের দ্বিতীয় ধাপ।এই নির্যাতন সম্পর্কে ইলা মিত্র রা
Post Written by : Md Abdul Bashir
Original Post URL : https://ift.tt/2GVko4y
Post Come trough : নাচোল নিউজ