‘আমিতো এসেছি চর্যাপদের অক্ষর গুলো থেকে /আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে /আমিতো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে /আমিতো এসেছি পাল যুগ নামে চিত্র কলা থেকে...’। কবি সৈয়দ শামসুল হকের এই পংক্তি মালায় বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অনবদ্য রূপ লাভ করেছে। বিশ্ব জুড়ে প্রত্যেক দেশে রয়েছে নিজস্ব শিল্প ও সংস্কৃতি। এই শিল্প ও সংস্কৃতির পরিচয়ে পরিচিত হয় সে দেশ বা জাতি। এক একটি শিল্পের বিস্তারের পিছনে রয়েছে একটি দেশ বা জাতির অবদান। বাংলাদেশ রূপ বৈচিত্রের দেশ। এদেশে অতীত কাল থেকেই হাজার ধরনের সংস্কৃতি পালন করা হয়। যার একটি নিদর্শন হলো ‘মৃৎশিল্প’। বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ঐতিহ্যের রূপকার হলেন কুমোর শ্রেণির পেশাজীবীরা। এদেশের কুমোর শ্রেণি হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত, পাল পদবিতে পরিচিত। বংশ পরম্পরায় তারা একাজ করে আসছেন। ’মৃৎ’ মানে মাটি আর ’শিল্প’ মানে সুন্দর সৃষ্টিশীল বস্তু। তাই মাটি দিয়ে নিজহাতে তৈরি শিল্পকর্মকে ‘মৃৎশিল্প’ বলে। কুমোররা অসম্ভব শৈল্পিক দক্ষতা ও মনের মধ্যে লুকায়িত মাধুর্য দিয়ে চোখ ধাঁধানো সব কাজ করে থাকেন। এই শিল্পটি হল বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও অন্যতম একটি শিল্প। মাটি দিয়ে তৈরি এই শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে হাঁড়ি-পাতিল, চাড়ি, কলস, বদনা, খানদা, ফুলের টব, ফুলদানি, জীবজন্তু, পাখির অবয়ব, ঘটি-বাটি, ডাবর-মটকি, প্রতিমা, মাটির ব্যাংক, শোপিস, পিঠা তৈরির ছাঁচ, নানা রকম খেলনা। এই শিল্পের প্রধান উপকরণ হল মাটি। অতীতে গ্রামের সুনিপুণ কারিগরের হাতে তৈরি মাটির জিনিসের কদর ছিল অনেকাংশে বেশি। পরিবেশ বান্ধব এই শিল্প শোভা পেত গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে। গ্রীষ্মকালে মাটির কলসির একগ্লাস পানি যেন দূর করে দিত সব ক্লান্তিকে। ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে জানা যায় মাটির শিল্প প্রথম চীনের বিখ্যাত শহর থাংশানে প্রচলিত ছিল।এই শহরটিকে মৃৎশিল্পের শহর বলা হয়। মিং রাজবংশের ইয়ং লে এর সময়কালে থাংশানে মৃৎশিল্পের উৎপত্তি ও বিকাশের সূত্রপাত হয়। বর্তমানে চীনে ৫০০টির বেশি মৃৎশিল্পের সামগ্রী দেখা যায়।চীনে এই মাটির তৈরি জিনিসপত্রকে বলা হয় ‘সেলাডন’ চীনারাই এশিয়া -ইউরোপে তাদের এই ‘সেলাডন’ ছড়িয়ে দেয়। প্রাচীনকাল থেকে মৃৎশিল্প বিভিন্ন সভ্যতায় অনেক মর্যাদা লাভ করেছে।আমাদের দেশের জাতীয় ঐতিহ্য ও গৌরবের নিদর্শন এই মৃৎশিল্প। আমাদের দেশে অনেককাল আগে থেকেই এই মৃৎশিল্পের চলন চলে আসছে। অতীতে যখন কাঁচ, সিরামিক, মেলামাইন, এলুমিনিয়াম এর প্রচলন ছিল না, তখন মানুষ মাটির তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহার করত। মাটির শিল্পেই এদেশের প্রাচীন শিল্পকলার পরিচয় পাওয়া যায়। এটি এদেশের নিজস্ব শিল্প। বৈশাখী মেলায় ও নানা পার্বনে গ্রামের কুমোরদের নিপুণভাবে তৈরি মাটির জিনিসপত্র অকৃত্রিম সৌন্দর্য বর্ধন করে। হাঁড়ি-পাতিল-কলসি ছাড়াও আমাদের দেশের এক সময়ে গড়ে উঠা সুন্দর পোড়ামাটির ফলকের কাজ যার নাম ‘টেরাকোটা’ তা এই প্রাচীন মৃৎশিল্পের অবদান। নকশা করা মাটির ফলক ইটের মত পুড়িয়ে তৈরি হত এই টেরাকোটা। ময়নামতির শালবন বিহার, বগুড়ার মহাস্থানগড় ও বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদে যেসব পোড়ামাটির ফলকের নিদর্শন রয়েছে সেইসব এই প্রাচীন মৃৎশিল্পের উদাহরণ। সম্প্রতি নরসিংদীর ওয়ারী বটেশ্বরে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে নানা ধরনের মাটির পাত্র আর ফলক, যা আমাদের ঐতিহ্য ও গৌরবের নিদর্শন। একটি সময় ছিল যখন প্রায় প্রতিটি ঘরে মাটির তৈরি তৈজসপত্রের ব্যবহার হত।নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় সহজ পরিবহণ, কাঁচামালের সহজলভ্যতা, পর্যাপ্ত জ্বালানি এবং সর্বোপরি দেশব্যাপী বিপুল চাহিদা থাকায় অতীতে মৃৎশিল্পের ছিল জয়জয়কার। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখনকার চিত্রটা ভিন্ন। কম চাহিদা, কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মাটির মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি সংকট, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসংগতি, ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতা ইত্যাদি নানা কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য এই মৃৎশিল্প। মূলত প্লাস্টিক, স্টিল, ম্যালামাইন, সিরামিক ও সিলভারসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থের তৈরি তৈজসপত্রের নানাবিধ সুবিধার কারণে দিন দিন আবেদন হারিয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প। এক সময় কুমোর পাড়াগুলো মাটির কাঁচাগন্ধে থাকত মাতোয়ারা। ব্যস্ত কুমোররা হিমশিম খেতেন চাহিদা মেটাতে। হাটবাজারে মাটির তৈজসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসতেন মৃৎশিল্পিরা। নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু ছাড়াও শিশুদের খেলনা, সৌন্দর্য বর্ধন সামগ্রীসহ বিভিন্ন বাহারি মাটির তৈজসে পূর্ণ থাকত কুমোর পাড়া। তখনকার প্রতিযোগিতার বাজারে বস্তুকে আকর্ষিত করতে দৃষ্টিনন্দিত আলপনার ছোঁয়াও দেয়া হত।কিন্তু আজ এই সবই অতীত।গাঁয়ের কুমোর পাড়ায় আর কাঁচামাটির গন্ধ তেমন পাওয়া যায়না। হাটবাজারে আর মাটির তৈজসপত্রের পসরা বসে না। নির্মম বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করে এখনো কিছু জরাজীর্ণ কুমোর পরিবার ধরে রেখেছে বাপ-দাদার পেশা। যা ‘মরা গাছে পানি দেওয়ার মত চলছে। কুমোররা অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে ফেলেছে। এখন তাদের কেউ কেউ স্বর্ণের কাজ, কেউ বিদেশে আবার কেউবা কামারের কাজ করছে। যে গ্রামের প্রায় সব বাড়িতে যেখানে দিনরাত ঘুরত কুমোরের চাকা, পানিতে মিশত নরম কাদা, রোদে শুকাত হাঁড়ি-পাতিল, পোড়ানো হত সেইসব জিনিস আর আচড় পড়ত রং তুলির কালের বিবর্তনে সেখানে কেবল লাভহীন এই পেশাকে বর্তমানে বাপ-দাদার পেশা রক্ষায় আঁকড়ে ধরে রেখেছে মুষ্টিমেয় কুমোর, যারা অনেকে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। আশার কথা হল কুমোর শিল্প আবার যেন তাঁদের নিঁখুত কাজের মাধ্যমে ফিরে আসছে আমাদের মাঝে। দেশ ছেড়ে বিদেশেও এখন ছড়িয়ে পড়ছে কুমোরদের হাতে তৈরি দৃষ্টিনন্দিত মৃৎশিল্পের শখের জিনিসপত্র। এককালের মৃৎশিল্পের তৈজসপত্র রাজা, জমিদার ও অভিজাত পরিবারের নিত্য ব্যবহার্য বস্তু এইকালের শিল্প সচেতন ব্যক্তিরা কদর করছেন বেশ। তাদের চাহিদায় শৌখিনতার অনুসঙ্গ হচ্ছে মাটির এসব জিনিস। মাটির তৈরি জিনিসপত্র দিয়ে ঘরের শোভা প্রকাশ করছে। সঠিক ব্যবহারে প্রশংসা ওপায় এইসব জিনিস ব্যবহারকারি। আর আমাদের কুমোররা নিজ প্রচেষ্টায় খুব অল্প দামে এই জিনিসগুলো সরবরাহ করছে দেশের সর্বত্র বিপনি কেন্দ্রে। বিলুপ্তির পথে চলে যাওয়া মৃৎশিল্প আবার যেন ফিরে আদছে তাদের নিঁখুত কাজের মাধ্যমে। একমাত্র সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে আমরা আমাদের শেকড়ের এই শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি যা আমাদের অন্যতম রপ্তানি পণ্য হিসেবে বিদেশে স্থান নিতে পারবে এবং আমাদের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। ভবিষ্যতে যেন এই শিল্প আর ধ্বংসের পথে ধাবিত না হয় সকল প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। মা আর মাটির সাথে এদেশের মানুষের নাড়ির টান। আবহমান কাল থেকেই বাংলা ও বাঙালি নামের সাথে মিশে আছে মাটির গন্ধ। কুমোর শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় অনন্য হয়ে উঠুক আমাদের মাটির দেশের এই মাটির শিল্প। মৃৎশিল্পীরা তাদের ভালবাসা ও মমতা দিয়ে সৃষ্টি করে যাক যুগে যুগে ঐতিহ্যের ইতিহাস। #savepottery #tradition #বাংলা #আমার_ঐতিহ্য #phela_boishakh #পহেলা বৈশাখ #মৃৎশিল্প Video Courtesy Socialbliss-bd.com photography
(RSS generated with FetchRss) ঢাকা বাজার on Facebook http://bit.ly/2nU0U58