বাঙালির প্রথাভাঙা প্রথম শিক্ষক
ফারজানা সিদ্দিকাপারিবারিক দারিদ্র্য তখনও কাটেনি তাঁদের। ১৮৩৯ সালের এপ্রিল মাসে হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্র কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করলেন। সেই কৃতিত্বের জন্যই তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হলো 'বিদ্যাসাগর' উপাধি। এই পরীক্ষা পাসের মধ্য দিয়েই আদালতে জজ পণ্ডিতের চাকরি পাবার সুযোগ এলো তাঁর জীবনে। জজ পণ্ডিতের কাজ হলো ইংরেজ বিচারকদের হিন্দু আইন বিষয়ে ব্যাখ্যা করা। সেই সময়ে অনেকের জন্যেই লোভনীয় ও প্রত্যাশিত ছিল চাকরি। বিশেষ করে, ঈশ্বরচন্দ্রের পরিবারের জন্যে তো বটেই। কিন্তু পিতা ঠাকুরদাসের পরামর্শে সেই চাকরিতে যোগ দেয়া হয়নি তাঁর। পিতা তাঁর পুত্রের 'বিদ্যাসাগর' উপাধিপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন যেন। আট বছর বয়েসে পিতার হাত ধরেই বীরসিংহা গ্রাম ছেড়ে উচ্চশিক্ষার জন্যে কোলকাতায় এসেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। পিতাই প্রথম বুঝেছিলেন, পুত্রের জন্যে বিত্তের চেয়ে বিদ্যা বড়। ফলে, আরও পড়াশুনার জন্য সেই অর্থকষ্টের দিনেও পুত্রকে উৎসাহ দিয়েছিলেন তিনি। হিন্দু ল কমিটির এই পরীক্ষা ঈশ্বরচন্দ্রকে কেবল 'বিদ্যাসাগর' উপাধিই দেয়নি, পরবর্তী সময়ে যথাযথ শাস্ত্র মেনে হিন্দু নারীর জন্য আইনগত লড়াইয়ের জন্য তাঁকে প্রস্তুত হতেও সাহায্য করেছে।
দীর্ঘ বারো বছর সংস্কৃত কলেজের পাঠ শেষে, ২২ বছর বয়সে, ১৮৪১ সালে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে সেরেস্তাদারির চাকরি পেলেন। যার সহজ বাংলা করলে দাঁড়ায়, হেড পণ্ডিতের চাকরি। অর্থাৎ, কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলা শেখানো। এই চাকরির জীবন পরবর্তীকালে তাঁর শিক্ষা সংস্কারের কাজের ক্ষেত্রে একধরনের ভিত রচনা করেছে। বাংলা শেখানোর ক্লাস করতে করতেই তিনি উপলব্ধি করছিলেন বাঙালি শিক্ষার্থীদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সেক্রেটারি ক্যাপ্টেন জি.টি. মার্শাল তাঁকে স্নেহ করতেন। তাঁরই উৎসাহে বিদ্যাসাগর নিজেও ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা শিখতে শুরু করেছিলেন। হিন্দি শেখার জন্য একজন হিন্দুস্তানি পণ্ডিতের কাছে যেতেন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ট্রেজারার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পরে তাঁর নিজেরই ছাত্র নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের কাছে নিতেন ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ। কিছুদিন রাজনারায়ণ বসুর কাছেও ইংরেজি শিখেছেন। শেক্সপিয়রের সাহিত্য পড়ার জন্য যেতেন সেই সময়কার বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত অনাদিকৃষ্ণ বসুর কাছে। মজার ব্যাপার হলো, 'ফ্রি শিক্ষায় অনাদর'-এ রকম ভাবনা থেকেই মাসিক পনেরো টাকা পারিশ্রমিক দিয়ে নিজের জন্য ব্যক্তিগত শিক্ষক হিসেবে হিন্দু কলেজের ছাত্র রাজনারায়ণ গুপ্তকে নিয়োগ দিলেন। ফলে, এই সময়টায়, বিদ্যাসাগর ছিলেন একইসঙ্গে শিক্ষক এবং ছাত্র। আরও একটা ব্যাপারে তাঁর এতদিনকার দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটছিল। সাহেবদের সান্নিধ্যে থেকে তিনি শিখছিলেন যুক্তি দিয়ে কাজের বিচার ও পরিকল্পনা করতে। এ কারণে, শিক্ষা সংস্কার বা স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে তাঁর প্রত্যেকটি রিপোর্ট যুক্তিনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।
সংস্কৃত ব্যাকরণ শেখানোর জন্য সে সময় শিক্ষার্থীদের মুগ্ধবোধ-এর ওপরই নির্ভর করতে হতো। এ বই থেকে ব্যাকরণ শিখতে তাদের চার-পাঁচ বছর লেগে যেত। ধনবান পরিবারের সন্তান রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় একটু বেশি বয়সেই বিদ্যাসাগরের কাছে ব্যাকরণ শিখতে এসেছিলেন। তাঁকে শেখাতে গিয়েই বিদ্যাসাগর সংস্কৃত ব্যাকরণের আদলে বাংলা ব্যাকরণ লেখার উদ্যোগ নিলেন। লিখলেন, উপক্রমণিকা ও ব্যাকরণ কৌমুদী। বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ, বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ, কথামালা, নীতিবোধ, বোধোদয়, চরিতাবলী, জীবনচরিত- এ সবই লেখা হচ্ছিল শিক্ষার্থীদের বাংলা শেখানোর পথকে সহজ করার লক্ষ্য নিয়ে। বিদ্যাসাগর বিশ্বাস করতেন, ভাষা শিক্ষার ভিত মজবুত হয় সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে।
চার বছর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে চাকরি করার পর ১৮৪৬-এ নিজেরই বিদ্যাপীঠ সংস্কৃত কলেজে সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দিলেন। শৈশবের সনাতন পণ্ডিতের পাঠশালা থেকে শুরু করে যত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি নিজে পড়েছেন এবং ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের বিদ্যাপীঠের কার্যক্রমকে ঠেলে সাজানোর পরিকল্পনা করলেন। ছাত্র থাকাকালেই শিক্ষাদানে সংস্কৃত কলেজের সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করেছিলেন তিনি। শিক্ষা-সংস্কারের ক্ষেত্রে এটাই ছিল বিদ্যাসাগরের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি রসময় দত্তের কাছে পেশ করলেন বিশাল এক রিপোর্ট। সেখানে একেবারে ঢেলে সাজানো হয়েছে সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যসূচি ও শিক্ষা-কার্যক্রম। স্বভাবতই সেক্রেটারির কাছে সেটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। শিক্ষার পুরাতন প্রথা থেকে সরতে রাজি নন সেক্রেটারি ও তাঁর অনুসারী শিক্ষকেরা। ফলে, সেক্রেটারির সঙ্গে বিরোধে চাকরি ছাড়লেন বিদ্যাসাগর। এই চাকরি ছাড়ার ঘটনাটি তখন কোলকাতায় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেক্রেটারি রসময় দত্ত নানাজনের কাছে বলে বেড়াতেন, 'বিদ্যাসাগর চাকরি ছেড়ে খাবে কী করে?' বিদ্যাসাগরও উত্তর দিতেন, 'মুদি দোকান দেবো, আলু-পটল বেচবো!'
আরও পরে, কাউন্সিল অভ এডুকেশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জে. ড্রিংকওয়াটার বেথুন বা বিটন সাহেব যোগদানের পর সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক ও সহকারী সম্পাদকের পদ লুপ্ত করে প্রিন্সিপাল পদ গঠন করা হয়। বিদ্যাসাগর হলেন সংস্কৃত কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল। এবার সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে কোনো বাধাই পেলেন না তিনি। শ্রীবিপিন বিহারী গুপ্ত রচিত পুরাতন প্রসঙ্গ বইয়ে সংস্কার আন্দোলনের এই সময়টা নিয়ে সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের ছাত্র কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেই সাক্ষাৎকারে প্রধান পাঁচটি সংস্কারের কথা উল্লেখ করেছেন কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য। সেগুলো হলো :
'১. ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ব্যতীত অন্য কোনও বর্ণের সংস্কৃত কলেজে প্রবেশ করিবার অধিকার ছিল না। তিনি ব্যবস্থা করিলেন, বর্ণবিশেষে হিন্দুর ছেলেমাত্রই কলেজে পড়িতে পারিবে।
২. ছাত্রদিগের নিকট হইতে বেতন লওয়া আরম্ভ হইল।
৩. ব্যাকরণ পড়ানোর সম্পূর্ণ পরিবর্তন হইল; 'মুগ্ধবোধ' উঠাইয়া দিয়া 'উপক্রমণিকা' পড়ান আরম্ভ হইল।
৪. অধিক ইংরাজি পড়াইবার ব্যবস্থা হইল। এত দিন ছাত্রেরা ইচ্ছামত ইংরাজি মাস্টারের কাছে অধ্যয়ন করিত। দুইজন ইংরাজি শিকক ছিলেন; ছেলেদের ইচ্ছা হইলে তাঁহাদের কাছে অধ্যয়ন করিত। এখন হইতে ইংরাজি পড়া কয়েক ক্লাস উপর হইতে compulsory হইল।
৫. সংস্কৃত গণিত-লীলাবতী, বীজগণিত ইত্যাদি পড়া উঠিয়া গেল; ইংরাজিতে অঙ্কশাস্ত্র পড়া আরম্ভ হইল।'
শিক্ষা কেবল ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের হাতেই কুক্ষিগত থাকলো না। নিজে তিনি ব্রাহ্মণ অথচ এইসব সংস্কারের মধ্য দিয়ে সর্বজনের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করলেন বিদ্যাসাগর। ইংরেজি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে ভারতবর্ষের যুবকদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুললেন। আর ইংরেজিতে গণিত শিক্ষার সুফল আজও পাচ্ছে ভারত। শিক্ষক এবং ছাত্র উভয় পক্ষেই 'ফ্রি শিক্ষায় অনাদর থাকে'- এমন ধারণা থেকেই বেতন নেয়ার প্রবর্তন করা হলো যেন সবকিছুতেই জবাবদিহি তৈরি হয়। এর পাশাপাশি যুক্ত করেছিলেন দর্শন শিক্ষা। এই দর্শন শিক্ষার প্রকল্প নিয়েও বিস্তর আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হিসেবে তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে, সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শনকে তিনি ভ্রান্ত দর্শন বলে মনে করেন। তাঁর এমন ঘোষণায় ক্ষেপে উঠেছিলেন সেই সময়কার ব্্রাহ্মণসমাজ। বরাবরের মতোই তোয়াক্কা করেননি তিনি। বারাণসী সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ জে. আর. ব্যালেন্টাইনের সঙ্গে দর্শন শিক্ষার কোর্স পরিকল্পনা বিষয়ক বিতর্কটি 'বিদ্যাসাগর-ব্যালেন্টাইন সংবাদ' হিসেবে তখন আলোচিত ছিল। বিদ্যাসাগর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের সমন্বয়ী শিক্ষার মধ্য দিয়ে ভালো/মন্দের যাচাই করতে শেখাতে চেয়েছেন শিক্ষার্থীদের।
সংস্কৃত কলেজে ক্লাস নিতেন না বিদ্যাসাগর। তাঁর প্রত্যক্ষ ছাত্রদের কাছ থেকে জানা যায়, কিছুটা তোতলা ছিলেন বলে খুব ধীরে ধীরে কথা বলার কৌশল রপ্ত করেছিলেন তিনি। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ছাত্রদের বিদ্যাসুন্দর-এর খেউড় অংশ পড়ানোর সময় লজ্জা পেতেন।
ক্লাস না নিলেও ক্লাসে উপস্থিত থাকতেন তিনি। ছাত্রদের ভিড়ে ক্লাসের পেছন দিকে চুপচাপ বসে থাকতেন। কোনও শিক্ষক ছাত্রদের ধমক দিয়ে বা চিৎকার করে পড়ালে পরে সেই শিক্ষককে ডেকে নিয়ে বোঝাতেন। এমনকি কোনও একজন ছাত্র হয়তো শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তর পারলো না, কিন্তু ক্লাসের অপর কোনও ছাত্র সেটি পারলো- এ রকম অবস্থায় উত্তর দিতে না পারা ছাত্রটিকে সকলের সামনে হেনস্থা না করার জন্য শিক্ষকদের নির্দেশ দিতেন। বিদ্যাসাগরের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের বেত মারা বন্ধ করা।
সংস্কৃত করেজের চাকরি ছাড়বার পর বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি 'মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন' গড়ে তোলা। মূলত এটি তিনি গড়ে তুলেছিলেন শিক্ষকদের ট্রেনিং দেবার জন্যে। ইংরেজ সরকারের স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি দেখেছেন বহু স্কুল কেবল শিক্ষকের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। যোগ্য শিক্ষক গড়ে তুলতে না পারলে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যর্থ হয়ে যাবে। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর স্মৃতিকথায় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, 'আমরা এখন চারিদিকেই বিদ্যালয় দেখিতেছি; প্রতি বছর সহস্র সহস্র বালক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতেছে; আমরা ভুলিয়া গিয়াছি, এই শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়কে কত ক্লেশ পাইতে হইয়াছিল। তিনি যখন নিজে পাশ্চাত্য জ্ঞানের আস্বাদন পাইলেন, তখন তাহা স্বদেশবাসীদিগকে দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। গবর্নমেন্টকে প্ররোচনা দিয়া তাঁহাকে কার্য করিতে হইয়াছিল! না ছিল উপযুক্ত শিক্ষক, না ছিল উপযুক্ত পাঠ্য পুস্তক। নিজে পাঠ্য পুস্তক রচনা করিতে আরম্ভ করিলেন; এবং অনেক স্থলে টোলের পণ্ডিতদিগকে ধরিয়া ভূগোল জ্যামিতি প্রভৃতি কিনিয়া দিয়া পড়াইয়া কাজ চালাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। এমন করিয়া তাঁহাকে শিক্ষা বিস্তার করিতে হইয়াছে।' ক্ষুদিরাম বসু বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত 'মেট্ে্রাপলিটান ইনস্টিটিউশন' এর শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি দেখেছেন, কীভাবে বিদ্যাসাগর ক্লাসের তদারকি করতেন, ছাত্রদের উৎসাহ দেবার জন্যে বি.এ. ক্লাসের পড়াশুনা ফ্রি করে দিলেন, ভালো শিক্ষককে ধরে রাখবার জন্যে বেতন বাড়িয়ে দিতেন, কলেজ শেষে বিকেলে কলেজের শিক্ষকেরা হাজির হতেন তাঁর বৈঠকখানায়, কলেজের সারাদিনের কর্মকাণ্ড শুনতে শুনতে নিজের হাতে আম কেটে খাওয়াতেন, সারাবছর নিজেই পরিবেশন করতেন অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী, শিক্ষকদের ব্যক্তিগত সংকটে পাশে দাঁড়াতেন- কোনো শিক্ষকের বোনের বিয়ের অর্থ জোগান দিতে অথবা কারও মায়ের স্বপ্ন পূরণে পুজোর আয়োজন করে দিয়ে। এমনকি পরীক্ষার আগে ছাত্রদের কাছে শিশুদের মতোই বায়না করে বলতেন, 'দেখ, পরীক্ষার ফল যদি ভালো না দাঁড়ায়, তা হলে সারকুলার রোড ধরে বাগবাজার হয়ে স্ট্র্রান্ড রোড দিয়ে সেই যে কর্ম্মাটারে চলে যাব, কলকাতায় আর মুখ দেখাব না।' কিন্তু এ বায়না কি শুধু ছাত্রদের পরীক্ষা পাসের জন্য, নাকি তাতে যুক্ত ছিল নিজেরও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার পরীক্ষা পাসের আকাঙ্ক্ষা?
'মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন'-এর প্রতিষ্ঠাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের নিরিখে বিচার করতে চেয়েছেন। 'বিদ্যাসাগর চরিত'-এ লিখলেন, 'বাঙালির নিজের চেষ্টায় এবং নিজের অধীনে উচ্চতর শিক্ষার কলেজ স্থাপন এই প্রথম। আমাদের দেশে ইংরাজি শিক্ষাকে স্বাধীনভাবে স্থায়ী করিবার এই প্রথম ভিত্তি বিদ্যাসাগর-কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হইল। যিনি দরিদ্র ছিলেন তিনি দেশের প্রধান দাতা হইলেন, যিনি লোকাচাররক্ষক ব্রাহ্মণপণ্ডিতের বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন তিনি লোকাচারের একটি সুদৃঢ় বন্ধন হইতে সমাজকে মুক্ত করিবার জন্য সুকঠোর সংগ্রাম করিলেন এবং সংস্কৃত বিদ্যায় যাঁহার অধিকারের ইয়ত্তা ছিল না তিনিই ইংরাজি বিদ্যাকে প্রকৃতভাবে স্বদেশের ক্ষেত্রে বদ্ধমূল করিয়া রোপণ করিয়া গেলেন।' সে সময় এই ইংরেজি বিদ্যাকেই আশ্রয় করে ইয়াং বেঙ্গল যে পোশাকী আধুনিকতাকে গ্রহণ করেছিল তার বিরুদ্ধে ধুতি-চাদর আর খড়ম পরা বিদ্যাসাগর একাই গড়ে তুলেছিলেন আধুনিকতার এক নতুন সংজ্ঞার্থ। ভারতবর্ষের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই রোপণকর্ম সত্যিই কি কোনো ভূমিকা রেখেছিল, রাখছে এখনও?
বিদ্যাসাগর বাংলা বইয়ের অভাব দূর করার জন্য নিজে যেমন অনুবাদের কাজে হাত দিয়েছিলেন, তেমনি অন্য কেউ অনুবাদের কাজ করছে জানতে পারলে সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। অব্রাহ্মণ হিসেবে ঋজ্ঞ্বেদসংহিতার অনুবাদের কাজে হাত দিয়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের তোপের মুখে পড়েছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত। একমাত্র বিদ্যাসাগর তাঁকে অনুবাদের কাজে সহায়তা তো করতেনই, নিরন্তর উৎসাহও জোগাতেন।
অগণিত শিক্ষার্থী তাঁর অর্থ সাহায্যে লেখাপড়া করতো। কেবল নিজের বাড়িতে রেখেই পড়াতেন না, দূর গ্রামের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বৃত্তি পাঠাতেন। নিজের গ্রামের স্কুলে মাসিক ভাতা দিতেন। তাঁর মৃত্যুর পরও যেন সেই ভাতা বন্ধ না হয় সেজন্য মৃত্যুর ষোলো বছর আগেই উইল করেছিলেন। নিজে তিনি হোমিওপ্যাথির চর্চা করতেন দরিদ্র রোগীদের সেবার জন্য। প্রিয় ছাত্রদেরও হোমিওপ্যাথি পড়বার জন্যে বই কিনে বা টাকা ধার দিতে চাইতেন। বাড়িতে এতজন পোষ্য শিক্ষার্থীর জন্যে টাকা বাঁচিয়ে জীবনধারণ করতেন। গাড়িতে উঠতে চাইতেন না, হাঁটতেন। দূরের বাজার থেকে সস্তায় কিনে আনতেন সবজি। কিন্তু, এর উল্টো চিত্রও আছে, পাঁচ টাকার বই মরক্কো চামড়ায় বাঁধাই করতেন দশ টাকা দিয়ে!
দেশের এক অংশকে অন্ধকারে রেখে যে সামগ্রিক উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয় সেই সত্যকে তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন। জানতেন বাধা আসবেই, তাই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো শাস্ত্রই ছিল তাঁর প্রধান হাতিয়ার। মেয়েদের স্কুলের কাঠামো না হয় গড়ে তোলা যায়, ইংরেজ সরকারের সাহায্য নিয়ে; কিন্তু ভারতবর্ষের প্রাচীন কুসংস্কার ভেঙে সেই স্কুলে মেয়েদের আনবার জন্যে শাস্ত্রবচনই খুঁজতে হয়েছে তাঁকে। স্কুলে মেয়েদের আনবার জন্য ব্যবহূত পাল্ক্কির দুই পাশে লিখিয়ে দিতে হয়েছে, 'কন্যাপেবং পালনীয় শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ'। সম্পাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন বেথুন স্কুলের সঙ্গে। ১৮৮৪ সালে বেথুন কলেজের ছাত্রী চন্দ্রমুখী বসু যখন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম ছাত্রী হিসেবে এম.এ পাস করেন, তখন বিদ্যাসাগর কেবল অভিনন্দনই জানাননি, তাকে উপহার দিয়েছিলেন এক সেট শেক্সপিয়রের রচনাবলি। যেসব বিধবা বালিকা তাঁর বাড়িতে নিশ্চিত আশ্রয় পেয়েছিল। তাদের তিনি নিজে লেখাপড়া শেখাতেন।
স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকাকালীন ১৮৫৭-'৫৮ এ তাঁর নিয়ন্ত্রাধীন চারটি জেলায় ৩৫াট বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে, ১৮৫৮ এর জুন মাসে জনশিক্ষা পরিচালকের এক চিঠি আসে, সেখানে জানানো হয় যে, নারীশিক্ষার অগ্রসরের জন্য সরকারি অর্থ সাহায্য প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিদ্যাসাগর কিছুতেই এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। স্কুলগুলো পরিচালনার জন্যে নিজের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অর্থ জোগান দিতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অন্যদিকে, অর্থ প্রত্যাহারের চিঠির বিরুদ্ধে জনশিক্ষা দপ্তরে নিয়মিত আবেদনও করতে থাকেন। তাঁর একাধিক আবেদনের প্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত সরকার কিছু অর্থ পুনরায় বরাদ্দ দেয়।
শেষ বয়সে নানা কারণে কোলকাতার ভদ্র সমাজকে পরিত্যাগ করে সাঁওতাল পরগনায় কর্মাটারে থাকতে শুরু করেছিলেন। সেখানেও নিয়েছিলেন সাঁওতাল শিশুদের শিক্ষা, চিকিৎসা এমনকি অন্ন জোগান দেয়ার দায়িত্ব।
ক্লাসরুমের ভেতরে এবং বোধকরি তারচেয়েও বেশি বাইরে বিদ্যাসাগর হয়ে উঠেছিলেন এক সার্বভৌম শিক্ষক। 'বিদ্যাসাগর :শিক্ষকের আদর্শ এবং আদর্শ শিক্ষক' নামে এক প্রবন্ধে অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক মোজাফফর হোসেন প্রশ্ন তুলেছিলেন, 'শিক্ষকের শিক্ষক কে? অর্থাৎ শিক্ষক কোথা থেকে জ্ঞান আহরণ করে নিজেকে ঋদ্ধ করবেন?' প্রাবন্ধিক নিজেই এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এভাবে, "...শিক্ষকের জ্ঞানের ভান্ডার শুধুই পুঁথি নয়। মানুষ ও তার সমাজ, পরিবেশ-পরিস্থিতি, নির্বিচার দেশাচার থেকে গ্রহণীয়-বর্জনীয় স্থির করে যা-কিছু মানুষের মনোজগতের রুদ্ধদুয়ার খুলে দিয়ে তার মৌলিক সৃজনশীল বৃত্তিকে প্রসারিত করার কাজে সাহায্য করে, তা সবই শিক্ষকের শিক্ষণীয় বিষয়। দ্বিতীয়ত, এই বিশাল জ্ঞানভান্ডার থেকে আহরিত জ্ঞান তিনি দেবেন কাকে?- এ জ্ঞান শুধু একটি শ্রেণীবিশেষের জন্য নয়। ব্যক্তিগতভাবে অর্জিত শিক্ষকের জ্ঞান সর্বসাধারণের সম্পত্তি। তাই আদর্শ শিক্ষককে হতে হবে গণ-শিক্ষক- তাঁর বক্তৃতা-বিবৃতি, আচার-আচরণ ও জীবনব্যাপী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। বিদ্যমান পরিবেশে সৃজনশীল শিক্ষার উপকরণ ও অবকাঠামো সহায়ক না হলে সে ব্যাপারে শিক্ষককেই নিতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। কারণ এ বিষয়গুলো সম্পর্কে অন্য কারো সচেতন থাকার কথা নয়। সমাজ-সংস্কারও শিক্ষকের দায়-দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সমাজের আবিলতা-পঙ্কিলতা থেকে গা বাঁচিয়ে শম্বুকবৃত্তি অবলম্বন করলে শিক্ষক 'মানুষ গড়ার কারিগর' হতে পারেন না।"- বিদ্যাসাগরের গোটা জীবনকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর মোজাফফর হোসেনের এই প্রশ্নোত্তরের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়া যায় অনায়াসে। যুগ বিবেচনায় গোপাল হালদার যাঁকে বলেছিলেন, 'বাঙালির প্রথম ও প্রধান শিক্ষাগুরু'- মূলত আজও তিনি বাঙালির প্রথাভাঙা প্রথম শিক্ষক।
সূত্র: সমকাল
পূর্বপশ্চিমবিডি/এসএস
Post Written by :
Original Post URL : https://ppbd.news/education/174603/বাঙালির-প্রথাভাঙা-প্রথম-শিক্ষক
Post Come trough : PURBOPOSHCIMBD