
পর্যটন একটি শিল্প। প্রকৃতি পাগল এবং ভ্রমণ পিপাষু মানুষ সময়-সুযোগ পেলেই পর্যটনের নেশায় ঘুরে বেড়ায়। বর্তমান সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হওয়ায় খুব সহজেই মানুষ একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দেশ-বিদেশ ঘুরে পর্যটনের আস্বাদ গ্রহণ করে থাকে। পত্র-পত্রিকা এবং বই পড়ার পাশা-পাশি এই পর্যটনের মাধ্যমেও মানুষ জ্ঞান অর্জন করে থাকে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও পর্যটনকে শিল্প হিসেবে সম্মানজনক স্থানে নিয়ে গেছে। এখন জেলাভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরনের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় স্থানীয় পর্যটন শিল্পের বিকাশ জরুরী।
সমাজে সংকট আর দূর্ভোগ সম্ভাবনারও পথ দেখায়। সমস্যা নিয়েই মানবজীবনের চাকা ঘুর্ণায়মান। জীবনচক্রে মানুষ দৈনন্দিন কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন এবং জীবনের আনুষঙ্গিক বিষয়াদি নিয়েই জীবিকায়ন পরিচালনায় অভ্যস্ত। তবে মাঝে মধ্যে এই চক্রের বাইরে গিয়ে একটু আনন্দ উপভোগ প্রতিটি মানুষের কাম্য। সাধারণত জাতীয় এবং পারিবারিক বিভিন্ন উৎসবগুলিতে মানুষ পরিবার পরিজনের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করতে ছুটে চলে শেকড়ের টানে। কিন্ত ভ্রমণ পিপাষু মানুষ এইটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। মানসিক আস্বাদ গ্রহনের জন্য ছুটে বেড়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে পর্যটনের নেশায়। আর এই পর্যটনের আস্বাদ গ্রহনের ক্ষমতা সকলের হয় না। কারণ এর সাথে আর্থিক সংগতি ছাড়াও আনুষঙ্গিক ব্যাপারগুলি জড়িত। যেমন কার সাথে যাবে, নিরাপত্তা কি হবে, সময় ও দুরত্ব কি রকম এবং পরিবেশ অনুকুল হবে কিনা ইত্যাদি।
যেকোন দেশ অথবা জেলার জন্য পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগ একটি লাভজনক ব্যাপার। সমীক্ষায় জানা গেছে, যেকোন বর্ধনশীল আয়ের রপ্তানি বাণিজ্যের চেয়েও বেশি লাভজনক এই পর্যটন শিল্প। যদি সেটা হয় সু-পরিকল্পিত এবং সুদৃশ্য। আমরা অনেকেই জানি চুম্বক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্যের কারনে নেপাল, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ,মালয়েশিয়া এবং ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আজ পর্যটনের আয় দিয়ে দেশের প্রবৃদ্ধি উন্নতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।
আমাদের সক্ষমতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিজের জেলার পর্যটন সম্ভাবনাকে বিশ্লেষণ করে আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে লালন করতে পারি। উত্তরের জনপদ গাইবান্ধা জেলা রংপুর বিভাগের ৮টি জেলার মধ্যে দক্ষিন-পূর্ব কোনে অবস্থান। ২১৭৯.২৭ বর্গকিঃ মিঃ দৈর্ঘের এই জেলার প্রায় ১০৭.৭ বর্গ কিঃ মিঃ নদী ও চর ভুমি। ইতোমধ্যে শহরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে নদী ও চর এলাকার জীবনচিত্র দর্শনে আগ্রহ কম নয়। জেলার ৭টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে প্রাচীন ঐতিহ্যের কিছু প্রতœ নিদর্শন এখনও দৃশ্যমান। অন্যদিকে কিছু স্থানে আধুনিক রুচিসম্মত কারুকাজ সমৃদ্ধ বিনোদন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। ভবিষ্যৎ প্রজম্মের নাগরিকদের নিজ জেলার বিভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানার সুযোগ তৈরী করে দেয়া উচিৎ।
বন্যা ও নদী ভাঙ্গন প্রবণ এলাকা হলেও এখানে ভ্রমন পিপাসু মানুষের ভ্রমনের জন্য রয়েছে বেশকিছু প্রাচীন প্রতœতত্ব ও ঐতিহাসিক স্থান এবং আধুনিক রুচিসম্মত কিছু দর্শনীয় স্থান। প্রাচীন ঐতিয্যের নিদর্শন হিসেবে রয়েছে রাজাবিরাট প্রাসাদ, নলডাঙ্গার জমিদার বাড়ী, বামনডাঙ্গার জমিদার বাড়ী, বর্ধনকুঠি জমিদার বাড়ী, গোবিন্দগঞ্জ মাস্তা মসজিদ, মীরের বাগনের ঐতিহাসিক শাহ্ সুলতান গাজীর মসজিদ, ভরতখালী কাষ্ঠ মন্দির (কালি মন্দির) মহিমাগঞ্জ চিনিকল, শিবরাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভবানীগঞ্জ পোষ্ট অফিস। অন্যদিকে আধুনিক কারুকাজ সমৃদ্ধ, বাহারী ফুলের সমারোহ এবং নিরর্মল পরিবেশে পরিপূর্ণ এসকেএস ইন্ রিসোর্ট, প্রাকৃতিক পরিবেশ বান্ধব ফ্রেন্ডশীপ সেন্টার, পৌরপার্ক গাইবান্ধা, বালাসীঘাট, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার ব-দ্বীপচরসহ বিভিন্ন স্থান। প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী বালাসীঘাটে স্থাপিত নৌবন্দরের কাজ সমাপ্ত হলে জেলার পর্যটন শিল্পে আর একটি নতুন মাত্রা যোগ হবে।
আমরা গাইবান্ধা জেলার পর্যটন শিল্পে যথেষ্ট সম্ভাবনার কথা এই জন্য বলতে পারি যে, পূর্বের তুলনায় মনোরম দৃশ্য আর মনোচাহিদার সমন্বয়ে বেশ কিছু বিনোদন কেন্দ্র আর আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যা সম্ভাবনাময় পর্যটনের জন্য সহায়ক। যার মধ্যে রয়েছে এসকেএস ইন্, ফ্রেন্ডশীপ সেন্টারসহ জেলা ও উপজেলা শহরের কেন্দ্রে বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা কিছু আবাসিক হোটেল। অন্যদিকে সরকারি আবাসিক কেন্দ্র সার্কিট হাউসও বর্তমানে করা হয়েছে আধুনিক রুচিসম্মত।
নদী ভাঙ্গন আর বন্যা কবলিত এলাকা হলেও এই জেলার রিসোর্টগুলিতে দর্শনার্থী আগমনের রেকর্ড মন্দ নয়। এসকেএস ইন্ এর ম্যানেজার তাইফুর কাদের জানান- গত ২০১৯-২০ অর্থ বছরে প্রায় ২৩ হাজার জন দেশী বিদেশী দর্শনার্থী এসকেএস ইন্ ভিজিট করেন। এবছর করোনার প্রভাবে কিছুটা কম হলেও আগামী দিনে উজ্জল সম্ভাবনাও অনুমান করছেন বলে জানান। তিনি বলেন- আগামী দিনে এই উজ্জল সম্ভাবনার নিরিখেই এসকেএস ইন্ এর আবাসন ব্যবস্থার সম্প্রসারণসহ মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যকে অপরুপ সৌন্দর্য্যে ফুটিয়ে তোলার কাজ অব্যহত রয়েছে। দেশি বিদেশী অতিথির আগমনে এসকেএস ইন্ রিসোর্ট ইতোমধ্যে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি লাভ করেছে।
অন্যদিকে ফ্রেন্ডশীপ সেন্টার ম্যানেজার (ফিল্ড অপারেশন) মো. লোকমান হোসেন জানান, গত ২০১৯-২০ অর্থ বছরে দেশি বিদেশী দর্শনার্থী ছিল প্রায় ১৫ হাজার জন। পর্যটনের সুত্রেই জেলার বাহিরে এবং অভ্যন্তরে মানুষে মানুষে বাড়ছে সম্প্রীতি, ভালবাসা এবং জেলার পরিচিতি। বিভিন্ন স্থান ভ্রমনের ফলে মানুষ পরিচিত হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতি আর ভৌগলিক বৈচিত্রের সাথে। বিকশিত হচ্ছে মানুষের জ্ঞানের ভান্ডার এবং বাড়ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। এটি নিঃসন্দেহে জেলার ঐতিহ্যকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখবে।
বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমাদের জেলার বন্যা, নদী ভাঙ্গন, করোনা প্রভাব, খরা, শীতের প্রকোপসহ নানা অস্থিতিশীল পরিবেশ সম্পর্কে প্রচারণাই বেশি। কিন্তু পর্যটনের ক্ষেত্রে মানুষ চায় সচ্ছলতা, শান্ত ও নিরুদ্বিগ্ন পরিবেশ। নেতিবাচক খবরের পাশাপাশি নিজ জেলার সম্ভাবনাময় তথ্যগুলিও ভ্রমণ পিপাষুদের সামনে তুলে ধরে জানান দেয়াটা জরুরী। ঐতিহ্য আর ইতিহাস সমৃদ্ধ স্থানগুলির প্রচারনা দরকার সাথে আধুনিক রুচিসম্মত বিনোদন কেন্দ্রের স্থানগুলি সম্পর্কে স্থানীয় মিডিয়াগুলিতে ব্যাপক প্রচারনা প্রয়োজন। প্রচারে প্রসারতার মাধ্যমেই মানুষের আগমন ঘটবে এবং জেলার অর্থনৈতিক অবস্থারও পরিবর্তন হবে।
বৈদেশিক সাহায্য সহযোগিতা আর ঋনের উপর নির্ভরশীলতা থাকলেও স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত জেলার পর্যটন শিল্পে সরকারিভাবে তেমন কোন বিশেষ বরাদ্দ নেই বল্লেই চলে। শুধু নামে একটি শিল্প হিসেবে বল্লেই হবে না কোন শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন এর যথাযথ যতœ ও পরিচর্যা। পরিকল্পিত ও বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মদ্যোগ গ্রহণ না করে ফল পেতে চাইলে তা কখনো সম্ভব হয় না। শুধু উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। অভ্যন্তরীন পর্যটন শিল্পে বরাবরই আমরা সীমাবদ্ধতার কথা শুনতে অভ্যস্ত। পর্যটকদের জন্য যাতায়াত, নিরাপত্তা ও সর্বপরি স্বাচ্ছন্দপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশ সম্ভব নয়।
এই অবস্থার প্রেক্ষিতে বৈচিত্র ও সুযোগ সৃষ্টির জন্য বেসরকারি উদ্দ্যোগকে স্বাগত জানাতে হবে। নিভৃত অঞ্চলের সৌন্দর্যমন্ডিত স্থানগুলোতে সরকারিভাবে পর্যটনের সার্বিক সুযোগ সুবিধা সৃষ্টির জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একই সাথে দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানগুলির স্বাভাবিকতা বজায় রেখেই সময়োচিত বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিয়ে পর্যটন শিল্প বিকাশের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে অনেকটা সমৃদ্ধ হবে বলে স্থানীয়রা মনে করেন। অভ্যন্তরীণ এবং স্থানীয় পর্যটন বিষয়ক ভাবনা-চিন্তার সম্প্রসারণ বৃদ্ধির মাধ্যমে নদী ভাঙ্গন ও বন্যা প্রবণ জেলার সমৃদ্ধতা অর্জনে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
মো. আশরাফুল আলম, সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী
সুত্র: আমারজেলা ডট নিউজ
Post Written by : Admin
Original Post URL : https://ift.tt/2ZQMp41
Post Come trough : নাচোল নিউজ